ক্যারিবো একবার ভয়ের চোখে বিচের ওপরদিকটা দেখে নিয়ে বলল, শুনেছি। কিন্তু ভয় পাইনি। কারণ তখনই দেখতে পেলুম, তোমরা দুজনে দিব্যি আস্তেসুস্থে হেঁটে আসছ। তোমাদের যখন বিপদ হচ্ছে না, তখন আমাদেরও হবে না ভাবলুম।
তারপর আমাদের ঢিট করার জন্য পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রইলে!
ক্যারিববা ধমক দিয়ে বলল, ন্যাকামি ছাড়ো। চলো কোথায় আছে রোজারিওর সোনাদানা? হাসতে হাসতে বললুম, কিন্তু এখন তো দিন ফুরিয়ে গেল। রাতে সেখানে যাবে কেমন করে? সকাল হতে দাও, তবে তো।
ক্যারিবো কথাটা তলিয়ে দেখে বলল, ঠিক আছে। সকালেই যাব। কিন্তু জায়গাটা কতদূর?
পশ্চিম প্রান্তে। পাহাড়ি খাদের ভেতর। সেখানে অজস্র নরকঙ্কাল আর খুলি পড়ে আছে। তারা কিন্তু জীবন্ত মানুষ দেখলেই—
আমার কথা শেষ হবার আগেই উংচু ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল, কর্তা! কর্তা! ওই শুনুন কে বাজনা বাজাচ্ছে আবার!
ক্যারিববা তাকে ধমক দিয়ে বলল, তুই জানিস না ব্যাটা, কিওটা দ্বীপের গাছপালা গান গায় আর বাজনা বাজায়?
ফুতাং ফিক করে হেসে বলল, শুনেছি, ওরা ধেই ধেই করে নাচেও।
ক্যারিবো আমাকে বলল, কী হে বাঙালিবাবু? গাছের নাচ দেখতে পাওনি?
বললুম, দেখিনি। তবে অসম্ভব নয়। একটা ক্যাকটাসকে তখন হেঁটে বেড়াতে দেখেছিলুম। কাজেই নাচতেও অসুবিধে কিসের? যাই হোক, ক্যারিববা! গুপ্তধনের জায়গায় তোমাকে নিয়ে যাব বলেছি—ঠিকই নিয়ে যাব। কিন্তু তার বদলে এই কি তোমার অতিথি সৎকারের নমুনা? আমাদের অন্তত এককাপ করে কফি খাওয়াও।
ক্যারিবো অচৈতন্য প্রিয়বর্ধনের দিকে তাকিয়ে বলল, হতচ্ছাড়াটা তো দেখছি ভিরমি খেয়ে পড়ে রইল। ওহে ফুতাং বেঁচে আছে তো?
ফুতাং বলল, আছে কর্তা। পিট পিট করে তাকাচ্ছে!
ক্যারিবো উঠে দাঁড়াল। উংচু, ফুতাং! তোরা এবার বোটটা এখানে টেনে নিয়ে আয়। খাবার দাবার, তাঁবু সব কিছু ওতে রয়ে গেছে। এখানে না আনলে মেরামত করব কেমন করে?
ওরা দুজনে পোশাক খুলে সাঁতারু সেজে জলে নামল। গোধূলির আলো তখনও ফুরিয়ে যায়নি। প্রবাল পাঁচিলের দিকে ওরা সাঁতার কেটে এগিয়ে গেল।
ক্যারিবো প্রিয়বর্ধনের ঘাড় ধরে টেনে বসিয়ে দিল। প্রিয়বর্ধন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আমার ও ক্যারিবোর দিকে। ওর কাছে গিয়ে বললুম, যা হওয়ার হয়ে গেছে। ক্যারিবোর সঙ্গে মিটমাট করে নাও। তোমাকে গুপ্তধনের জায়গায় পৌঁছে দিলে আমাদের ছেড়ে দেবে ক্যারিবো?
প্রিয়বর্ধনকে চোখের ইশারা করতেই সে বুঝে নিল ব্যাপারটা। বলল, ঠিক আছে।
ক্যারিবো খুশির ভাব দেখিয়ে বলল, হ্যাঁ—পৌঁছে দিলেই তোমাদের ছুটি। শুধু তাই নয়, কিছু ভাগও পাবে। এমনকী, রুবি দ্বীপে পৌঁছেও দেব।
আমি যেমন জানি, তেমনি প্রিয়বর্ধনও টের পেল, ক্যারিবো আমাদের কী দশা করবে শেষ পর্যন্ত। বুদ্ধিমান প্রিয়বর্ধন মাতৃভাষায় কথা বলতে শুরু করল ক্যারিববার সঙ্গে। বুঝতে পারছিলুম, সে অনুনয়-বিনয় করে ক্ষমা চাইছে।
অনেক দেরি করে ফিরল ফুতাং ও উংচু। ততক্ষণে এক ফালি চাঁদ উঠেছে। সমুদ্রে ওপর ক্ষীণ জ্যোৎস্না খেলছে। বিচের ওপর সেই বেহালা বাজিয়ে গাছটা মাঝে মাঝে যেন বেহালার ছড়া টেনে করুণ সুর বাজাচ্ছে আবার থেমে যাচ্ছে। মোটরবোটটা টেনে বালিতে তুলল ওরা। ক্যারিবো রিভলভার হাতে নিয়ে আমাদের পাহারা দিচ্ছে। জিনিসপত্র নামিয়ে আনতে হুকুম দিল সে।
একটু পরে বিচের মাথায় উঁচু জায়গায় একটা তাঁবু খাটানো হল। তারপর স্টোভ জ্বেলে কফি বানাল ওরা। ফুতাং রাতের খাবার তৈরি করতে ব্যস্ত হল। বুঝলুম, রীতিমতো তৈরি হয়েই এসেছে। কিন্তু কিওটা দ্বীপের সন্ধান কীভাবে পেল, বুঝতে পারলুম না।
তাই বললুম, ক্যারিবো, কফির জন্য ধন্যবাদ। এবার বলো, কেমন করে তোমরা এ-দ্বীপের খোঁজ পেলে?
ক্যারিবো ধূর্তের হাসি হেসে বলল, তোমরা যেভাবে পেয়েছিলে!
আমরা দৈবাৎ এখানে ভেসে এসেছি, ক্যারিবো। বিশ্বাস করো।
করছি না। কারণ আমি জানি, তোমরা সেই ছোট্ট মূর্তির ভেতর লুকিয়ে রাখা কাত্তির সংকেত সূত্র উদ্ধার করতে পেরেছ। ওতে কিওটা দ্বীপের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ লেখা আছে। তোমরা ভেবেছিলে আমি ভীষণ বোকা। জানো না যে আমি আগেই কাত্তিটার সব চিহ্ন কাগজে কপি করে রেখেছিলুম।
কিন্তু সংকেত সূত্রগুলো তো অর্ধেক মনে হয়েছিল। অন্য কাত্তিটা না পেলে…
আমার কথা কেড়ে ক্যারিবো বলল, না হে বোকারাম! তা নয়। রাজাকো আসল কাত্তিটার একটা নকল বানিয়েছিল। যদি দৈবাৎ একটা খোয়া যায়, অন্যটা থাকবে। ওর টুপির ভেতরকার কাত্তিটা নকল। আসলটা ছিল মূর্তিটার ভেতরে। কাত্তিতে যে চিহ্নগুলো আছে, তার অর্থ কেবলমাত্র জানে অভিজ্ঞ নাবিকরা। কিয়াংয়ের মতো অভিজ্ঞ সমুদ্রচর লোক, কিংবা এই দেখছ আমাকে—আমার মতোও যারা সমুদ্রে ঘোরে এবং অভিজ্ঞ নাবিকদের শাগরেদি করে বড় হয়েছে, তারা সবাই ওইসব চিহ্নের অর্থ বোঝে। কিন্তু বরাত মন্দ, পৌঁছুলুম বটে কিওটায়, মোটরবোটটা কোরাল রিবে (Coral Reeb) ধাক্কা খেয়ে বিগড়ে গেল। দেখা যাক, সারাতে পারি নাকি। তবে তার আগে রোজারিওর গুপ্তধন তো আগে হাতাই। তারপর দেখা যাবে।…
রোজারিওর গুপ্তধনের লোভে ক্যারিবো আমাদের এ-রাতে এত খাতির করছিল কহতব্য নয়। খাবারের ভাগ দিয়ে তো বটেই, আরও খিদে আছে কি না জিগ্যেস করে আতিথেয়তার চূড়ান্ত করল।
আমাকে ও প্রিয়বর্ধনকে দক্ষিণী মহাসাগর এলাকার নাবিকদের প্রিয় কড়া সিগারেটের প্যাকেট পর্যন্ত উপহার দিল। কিন্তু আমরা দুজনেই জানি, শয়তানটার মনে কী ক্রুর মতলব খেলা করছে।