শব্দগুলো যেন সারা দ্বীপ জুড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে। তারপর শোনা গেল, আই মাস্ট কিল ইউ!…কিল ইউ… কিল..কিল! তারপর আর্তনাদ! হেল্প! হেল্প! হেল্প! সেই সঙ্গে
অন্তিম আর্তনাদের পর আর্তনাদ!
প্রিয়বর্ধন জঙ্গলের ভেতর উদ্ভন্তের মতো দৌড়ুচ্ছিল। তার ধরে ফেললুম। বললুম, ও কিছু নয়, প্রিয়বর্ধন! অতীতের প্রতিধ্বনি মাত্র। অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
প্রিয়বর্ধন ধুপ করে ঘাসে বসে পড়ল। তারপর ভয়ার্ত মুখে বলল, রোজারিওর ভূত, জয়ন্ত! শুধু একা নয় ওর দলের সবাই ভূত হয়ে গেছে। আমাদের বরাত বড় মন্দ। তুমি বুঝতে পারছ না? ভূত হয়ে গেছে। ওরা ভূত হয়ে গুপ্তধন পাহারা দিচ্ছে।
ওকে টেনে ওঠালুম। কাল সকাল থেকে খোঁজা যাবে। আমরা পুব দিকের বিচে যাই। বেলা পড়ে আসছে। অচেনা জায়গার চেয়ে চেনা জায়গায় রাত কাটানোই ভালো।
দুজনে বাঁ দিকে ঘুরে কঁকা মাঠের দিকে এগিয়ে গেলুম। বনের ভেতর কোথাও ক্ষীণ সুরে বাঁশি বাজছিল। ক্রমশ সেই সুর চাপা দিয়ে গম্ভীর অর্কেস্ট্রা শুরু হল। প্রিয়বর্ধন ভয় পেয়ে লম্বা পায়ে হাঁটতে থাকল।
কিন্তু ফাঁকা মাঠের ধারে পৌঁছতেই এক বিচিত্র দৃশ্য চোখে পড়ল।
ক্যাকটাস জাতীয় একটা অদ্ভুত গড়নের প্রাণী কিংবা নিছক গাছ আস্তেসুস্থে হেঁটে যাচ্ছে। প্রিয়বর্ধন বলে উঠল, ও কী জয়ন্ত! ওটা গাছ, না কোনও জন্তু?
অবাক হয়ে বললুম, আশ্চর্য! ওটা যে দেখছি একটা ক্যাকটাস! চলো, তো দেখি।
প্রিয়বর্ধন আমার পিছনে কুণ্ঠিতভাবে এগুলো। সেই বিচিত্র চলমান ক্যাকটাসের হাত দশেক দূরে পৌঁছলে সেটা থেমে গেল। তারপর আরও অবাক হয়ে দেখলুম, ওটার নিচের দিক থেকে একরাশ শেকড় কেঁচোর মতো নেমে মাটিতে ঢুকে গেল।
সাহস করে কাছে গেলুম। সত্যি ক্যাকটাসই বটে। এমন বিদঘুটে চলমান ক্যাকটাস দেখে আমি হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম কিছুক্ষণ।
প্রিয়বর্ধনের তাড়ায় এগিয়ে যেতে হল। কিছু দূরে গিয়ে একবার পিছু ফিরে দেখলুম, অদ্ভুত ক্যাকটাস জীবটি আবার চলতে শুরু করেছে। বললুম, প্রিয়বর্ধন! তাহলে দেখা যাচ্ছে চলমান উদ্ভিদও পৃথিবীতে আছে। কে জানে এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপে আরও কত বিচিত্র উদ্ভিদ দেখতে পাব।
প্রিয়বর্ধন সে কথায় কান না করে একটু হেসে বলল, আবার কিন্তু খিদে পেয়েছে!
মাঠের ভেলভেটের মতো নরম সবুজ ঘাসের ওপর সেই পিচ জাতীয় ফলের গাছ আরও অনেক আছে। একটা গাছের দিকে পা বাড়িয়েছি, সেই সময় প্রিয়বর্ধন বলে উঠল, জয়ন্ত! জয়ন্ত! ওটা কী দেখ তো?
ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি, শেষ বিকেলের সমুদ্রের প্রবাল পাঁচিলের সেই ভাঙা অংশটার কাছে সাদা কী একটা ঢেউয়ে ভেসে উঠছে আবার যেন তলিয়ে যাচ্ছে। ভাল করে দেখে বুঝলুম, ওটা একটা মোটরবোটই বটে!
আনন্দে চিৎকার করে দৌড়ুতে যাচ্ছিলুম, হঠাৎ বাঁ পাশে পড়ে থাকা কয়েকটা পাথরের আড়াল থেকে তিনটে মূর্তি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যান্ডস্ আপ!
মূৰ্তিত্রয় এ-দ্বীপের কোনও আজব গাছ-মানুষ, না আমাদের মতো মানুষ লক্ষ্য করতে গিয়ে চোখে পড়ল, তাদের হাতে রিভলভার আর বন্দুকও আছে। সঙ্গে সঙ্গে দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে গেলুম।
তারপর প্রিয়বর্ধন দুহাত তুলে ফিসফিস করে উঠল, শয়তান ক্যারিববা!
এবার চিনতে পারলুম ক্যারিবোকে। সে এগিয়ে এসেই প্রিয়বর্ধনের চোয়ালে রিভলভারের বাঁট দিয়ে মারল। প্রিয়বর্ধন পড়ে গেল। তারপর ক্যারিবো আমার দিকে ঘুরে কুৎসিত হেসে বলল, এই যে কলকাতাওয়ালা বাঙালিবাবু। মোটর বোট চুরির শাস্তি কত ভয়ঙ্কর, একটু-একটু করে টের পাবে এবার। ফুতাং! একে বিচে নিয়ে চল্! আর উংচু, তুই ওই দোআঁশলা বদমাশটাকে তুলে নিয়ে আয়।
গরিলার মতো চেহারা—সম্ভবত মালয়ের লোক, সেই ফুতাং এসে আমার ঘাড় ধরল। ওর অন্য হাতে বন্দুক। কিছু করার নেই। উংচু নামে বেঁটে হিংস্র চেহারার লোকটার গায়ে যেন দৈত্যের বল। সে প্রিয়বর্ধনকে পুতুলের মতো কাঁধে তুলে নিয়ে চলল পুবের বিচের দিকে। প্রিয়বর্ধন অজ্ঞান হয়ে গেছে। কষায় রক্ত গড়াচ্ছে।
বিচের বালিতে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল ফুতাং। ক্যারিববা বিকট হেসে বলল, তারপর বাঙালিবাবু! প্রথমে বলো তো গুপ্তধনের হদিশ কতটা পেলে? তারপর অন্যকথা।
১৩. ক্যাকটাস-মাকড়সা ও বেতারযন্ত্র
ক্যারিববার চোখের ভেতর হিংসা যেমন, তেমনি লোভও ঝকমক করতে দেখছিলুম। সে আমাদের মেরে ফেলবে ঠিকই, কিন্তু তার আগে জেনে নিতে চায়, আমারা গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছি কি না। পেয়ে থাকলে ওকে আর কষ্ট করতে হবে না এবং আমরা সেখানে তাকে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সে আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে।
তাই একটু হেসে বললুম, ক্যারিবো রোজারিওর গুপ্তধন যেখানে পোঁতা আছে, সেখানে যাওয়ার অনেক বিপদ।
ক্যারিবো আমার পাশে হাঁটু দুমড়ে বসে হিস হিস করে বলল, বাজে কথা রাখো। খোঁজ পেয়েছ কি না জানতে চাই। যদি পেয়ে থাকো, তোমার অন্তত বাঁচার আশা আছে। তবে ওই নচ্ছার বিশ্বাসঘাতকটাকে মেরে ফেলব। ডাইনির দ্বীপের একটা গাছে রবারের ভেলা টাঙানো আছে। দেখেই বুঝেছিলুম, কে আমাদের মোটরবোট চুরি করে পালিয়েছে। যাই হোক, সে-সব কথায় লাভ নেই। বলো, গুপ্তধনের খবর কী?
বললুম তো! সেখানে কোনও মানুষ যেতে পারে না।
কেন?
রোজারিও আর তার স্যাঙাতদের আত্মা সেই ধন পাহারা দিচ্ছে। তুমি কি এই দ্বীপে পৌঁছে তাদের চিৎকার শোনোনি?