ঝাঁকে ঝাঁকে ব্যুমেরাং গড়নের কাঠপোকা বা কেঠো পোকা সবুজ ঘাসের মাঠে বসে ছিল। আমরা তাদের মধ্যে গিয়ে পড়তেই তারা লাফাতে লাফাতে কে কোথায় লুকিয়ে পড়ল। প্রিয়বর্ধনের চোখ সেদিকে নেই। মুখেচোখে ধূর্ততা ঠিকরে পড়ছে। মাঝে মাঝে বলছে, আমরা রাজা হয়ে যাব, জয়ন্ত! রোজারিওর ধনরত্ন পেলে আর পরোয়া নেই।
রোজারিও কে, সেকথা কয়েকবার জিগ্যেস করেও জবাব পেলুম না। তখন ভাবলুম, নিশ্চয় কোনও প্রাচীন জলদস্যু হবে। রাজাকো, ক্যারিবো, কিয়াং—সবাই তাহলে এই জলদস্যু পুঁতে রাখা গুপ্তধনের জন্য হন্যে হয়ে পরস্পর লড়াই করেছে। রাজাকোর প্রাণ গেছে। ক্যারিববা আর কিয়াং এখনও জীবিত। এখন কোথায় তারা কে জানে? ক্যারিববার সঙ্গে ডাইনির দ্বীপে আমাদের দেখা হয়েছে। তার মোটরবোট চুরি করে আমরা পালিয়ে এসেছি। ক্যারিববার দশা কী হয়েছে, তাও বলা কঠিন।
তারপর মনে পড়ল কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের কথা। ডঃ বিকর্ণ, কাপ্তেন ঝুগেনভিলি, আর রোমিলার কথা। মন অমনি খারাপ হয়ে গেল। নৌবাহিনীর সাহায্যে তাঁরা কি রুবি দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রে আমার মৃতদেহ খুঁজে বেড়াচ্ছেন এখনও? আচ্ছা, কাপ্তেন ঝুগনভিলি তো এ-দ্বীপে এসে পড়েছিলেন। তার কি পথের কথা মনে নেই একটুও?
কিওটো যে ছোট্ট দ্বীপ, সেটা ক্রমশ বুঝতে পারছিলুম। উত্তর থেকে সোজা দক্ষিণে দু-মাইল গিয়েই আবার সমুদ্র দেখা গেল। তারপর পশ্চিমে এগিয়ে গেলুম আমরা। পশ্চিম এলাকাটা ছোট-বড় পাহাড়ে দুর্গম হয়ে আছে। একেবারে ন্যাড়া পাথুরে পাহাড়। কিন্তু কী বিচিত্র রঙ তাদের। কোনওটা কালো, কোনওটা লাল, হলুদ, নীল। একটা সবুজ রঙের পাহাড়ও দেখতে পেলুম। এদিকে গাছপালা নেই বললেই চলে। একটা লাল টিলার ওপর পৌঁছে দ্বীপটা পুরো চোখে পড়ল।
দ্বীপটার গড়ন তিনকোনা। মধ্যিখানে বিরাট সবুজ ফঁকা মাঠ। মাঠ জুড়ে টুকরো পাথর পড়ে আছে। উত্তর ও দক্ষিণে ঘন বন। পুবে কিছুটা ফাঁকা। কিন্তু তিনকোনা দ্বীপটাকে ঘিরে রেখেছে প্রায় গোলাকার প্রবাল পাঁচিল। এটাকে বলয় দ্বীপ বলা যায়। প্রবাল পাঁচিলটা শুধু পুবের দিকে এক জায়গায় ভাঙা এবং সেটাই এই দ্বীপে ঢোকার গেট যেন। ওই গেট দিয়ে আমরা আসতে পেরেছি। বাকি সমস্ত বলয় উঁচু হয়ে ঘিরে রেখেছে পাঁচিলের মতো। তার গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে মহাসাগরের প্রচণ্ড সব ঢেউ। আছড়ে পড়ে ধুয়ে দিচ্ছে পাঁচিলকে। এতক্ষণে সামুদ্রিক পাখির ওড়াউড়ি চোখে পড়ল প্রবাল বলয়ের কাছে।
প্রিয়বর্ধন বলল, তাহলে মোটামুটি একটা ম্যাপ পাওয়া গেল। এবার জয়ন্ত, আমরা কিছু সূত্র খুঁজব।
কিসের সূত্র?
প্রিয়বর্ধন হাসল। রোজারিও যখন এ দ্বীপে ধনরত্ন পুঁততে এসেছিল, তখন নিশ্চয় কিছু চিহ্ন রেখেছিল। ধরো, জাহাজের একটুকরো কাঠ, কিংবা পেরেক। অথবা একটা হাতুড়ি।…… যাই হোক, খুঁজলে নিশ্চয় পেয়ে যাব কিছু। এখান থেকেই খুঁজতে শুরু করি।
প্রিয়বর্ধন, এ-দ্বীপে যেই এসেছে, তাকে আসতে হয়েছে পুবের ওই ভাঙা জায়গাটা দিয়ে। কাজেই….
আমার কথা কেড়ে প্রিয়বর্ধন বলল, ওহে বোকারাম! যেখান দিয়েই আসুক, গুপ্তধন লুকানোর জন্য দুর্গম জায়গা সে বেছে নেবে কি না?
তা ঠিক।
দুর্গম জায়গা বলতে দেখছি, এই পাহাড়ি এলাকা আর ওই ঘন জঙ্গল। এখান থেকেই শুরু করি। এস। বলে প্রবল উৎসাহে সে টিলা থেকে নামতে থাকল।
তাকে অনুসরণ করলুম। দুপুর গড়িয়ে গেছে। এত ঘোরাঘুরি করছি, অথচ একটুও ক্লান্তি লাগছে না। নিশ্চয় সেই ফলের গুণ। টিলার নিচে পৌঁছে একটা পাহাড়ি খাদের দিকে পা বাড়াল প্রিয়বর্ধন। ডান দিকে এক ছিপছিপে চেহারার গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই গাছটা হঠাৎ পিয়ানোর বাজনা বাজাতে শুরু করল। কী মনমাতানো সে সুর! আমি দাঁড়িয়ে পড়লুম।প্রিয়বর্ধন! শোনো, শোনো! বলে ডাকলুম। কিন্তু সে দাঁত মুখ খিচিয়ে বলল, কী শুনব? আমার এক খুড়ো ওর চেয়ে ভাল পিয়ানো বাজাতে পারে! দেখছ না? বাতাস বইছে বলেই গাছটা এমন বিচ্ছিরি ভূতুড়ে শব্দ করছে। চলে এস।
বেরসিক প্রিয়বর্ধনের টানে এগিয়ে যেতে হল। খাদটা ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে। খাদের দুধারে রঙিন পাহাড় দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক পা এগিয়ে প্রিয়বর্ধন হঠাৎ বসে পড়ল। তারপর উত্তেজিতভাবে বলল, পাওয়া গেছে! পাওয়া গেছে!
গিয়ে দেখি, একটা মরচে ধরা লোহার রড মাটির ভেতর কাত হয়ে ঢুকে রয়েছে। সেটা টানাটানি করতেই খানিকটা চাবড়া উঠে গেল মাটির। তারপর যা দেখলুম, ভয়ে বিস্ময়ে শিউরে উঠলুম। ওটা রড নয় আসলে একটা তলোয়ারের বাঁট। আর চাবড়ার তলায় একটা মানুষের কঙ্কাল দেখা যাচ্ছে। তালোয়ারটা কঙ্কালের ভেতর বিধে রয়েছে। রুদ্ধশ্বাসে বললুম, প্রিয়বর্ধন! কেউ এই মানুষটাকে তালোয়ার বিধিয়ে খুন করেছিল। সেই অবস্থায় পড়ে ছিল মৃতদেহটা। বছরের পর বছর বৃষ্টিতে মাটি ধুয়ে ঢালু খাদে এসে জমেছে আর ওকে ঢেকে ফেলেছে।
প্রিয়বর্ধন বলল, এ তাহলে নিশ্চয় রোজারিওর দলের লোক। এস, এগিয়ে গেলে আমরা আরও সূত্র পাব।
আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ালুম। খাদে বিকেলের গাঢ় ছায়া জমে আছে। আর এখানে ওখানে পড়ে আছে আরও কয়েকটা নরকঙ্কাল। কোনওটা মুণ্ডুহীন। মুণ্ডটা পড়ে আছে। আলাদা হয়ে। কালো ছায়ায় কঙ্কাল আর খুলিগুলো ধপধপে সাদা দেখাচ্ছে। দেখলে আতঙ্কে শরীর হিম হয়ে যায়।
তারপর হঠাৎ আগে শোনা সেই চিৎকার বা গর্জন শুনতে পেলুম।স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে স্টপ ইট! দু-ধারের পাহাড়ে গম গম করে প্রতিধ্বনি উঠল। কানে তালা ধরে যাচ্ছিল। সেই সময় দেখলুম প্রিয়বর্ধন আতঙ্কে পাগলের মতো যে পথে এসেছি, সেই পথে দৌড়তে শুরু করেছে। আমি তাকে অনুসরণ করলুম।