হাসতে হাসতে বললুম, আপেল গাছটার তোমাকে পছন্দ হয়নি। এস, আমি তোমাকে আমার বন্ধুর বাড়ি নিয়ে যাই। ফল খাইয়ে আনি।
সন্দিগ্ধ মুখে পা বাড়াল প্রিয়বর্ধন। বলল, এ দ্বীপে তোমার বন্ধু জুটেছে বুঝি? কিন্তু ঘর-বাড়ি বা মানুষজন তো চোখে পড়ল না!
এসোই না।বলে কয়েক পা এগিয়ে গেছি, সেই সময় ডান দিকের উঁচু উঁচু গাছগুলোর ভেতর থেকে সেই খ্যান খ্যান চিৎকার জেগে উঠল—স্টপ ইট! স্ট ইট! আই সে-স্টপ ইট! প্রিয়বর্ধন দাঁড়িয়ে গেল। বলল, ওরে বাবা! ওই শোনো কারা ঝগড়া করছে।
তাকে তখনও খুলে বলিনি, আমরা কিংবদন্তিখ্যাত কিওটা দ্বীপে আছি। বললে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, বুঝতে পারছিলুম না। কারণ, এ দ্বীপে নাকি গুপ্তধন আছে বলে তার বিশ্বাস আছে। ভেবেছিলুম, গুপ্তধনের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে আমার সঙ্গে তার বন্ধুতা চটে যেতে পারে।
একটু পরে মাঠের মাঝামাঝি গেলে বাঁ দিকের জঙ্গলের ভেতর আজও সেই চাপা গম্ভীর অর্কেস্ট্রার বাজনা বেজে উঠল। প্রিয়বর্ধন খুশিতে নেচে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। গির্জায় প্রার্থনাসঙ্গীত হচ্ছে জয়ন্ত! চলো, চলো—আমরা আগে ওখানে যাই!
প্রার্থনাসঙ্গীত শুনে প্রিয়বর্ধনের কেমন যেন ঘোর লেগেছে। অস্থির হয়ে বলল, আমি একজন খ্রিস্টান, জয়ন্ত। তুমি হিন্দু। ওই প্রার্থনা-সঙ্গীতের মর্ম তুমি বুঝবে না। তুমি আমার সঙ্গে যাবে তো এস, আমি চললুম। প্রার্থনায় যোগ না দিলে আমার পাপ হবে।
এই বলে সে দৌড়ুতে শুরু করল। আমি ওকে ডাকাডাকি করেও ফেরাতে পারলুম না। দেখতে দেখতে সে বনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।
অগত্যা সেই দয়ালু গাছটার উদ্দেশে এগিয়ে গেলুম। এখনই প্রিয়বর্ধন হন্যে হয়ে ফিরে আসবে।
তাই এল—যখন আমি রসালো পিচ জাতীয় ফল খাচ্ছি। খাচ্ছি মানে ঘাসের ওপর বসে হাঁ করছি, আর একটা করে থোকা আমার মুখে ঢুকছে।
প্রিয়বর্ধনকে দেখে বললুম, কী? খুঁজে পেলে গির্জা!
প্রিয়বর্ধন সে কথার জবাব দিল না। আমার কাণ্ডটা তার চোখে পড়েছিল। সে অবাক হয়ে একটুখানি দেখার পর ধুপ করে বসে পড়ল এবং প্রকাণ্ড হাঁ করল।
মনে হচ্ছিল, আমার দাতা ভদ্রলোকের ভাঁড়ার এবেলাতেই সে উজাড় করে ছাড়বে। এক গাদা ফল গিলে পেটটা ঢাকের মতো ফুলিয়ে বিকট এক ঢেকুর ছেড়ে সে ফিক করে হাসল। বলল, জয়ন্ত! আমি স্বপ্ন দেখছি। তাই না?…
১২. আবার শয়তানের কবলে
সেদিন দুপুর অব্দি প্রিয়বর্ধন স্বপ্ন স্বপ্ন করেই কাটাল! তার পাগলামি দেখে হাসি পাচ্ছিল। সে এই উৎকট স্বপ্ন ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে তার গায়ে চিমটি কাটতে বলেছিল। নিজেও চেষ্টা করছিল স্বপ্নটা যাতে ভাঙে। নিজের মাথায় চাঁটি মেরে, কখনও ডিগবাজি খেয়ে, কখনও বা গাছের গুড়িতে ঢু মেরে সে একসময় বাচ্চা ছেলের মতো ভ্যা করে কেঁদেও ফেলল।
তখন আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। হাসতে হাসতে বললাম, প্রিয়বর্ধন, তুমি কি এখনও টের পাচ্ছ না যে ব্যাপারটা স্বপ্ন নয় বাস্তব।
প্রিয়বর্ধন চোখ মুছে নাক ঝেড়ে বলল, অসম্ভব! জয়ন্ত, আমরা হয়তো আসলে কোনও ডাইনির দ্বীপে এসে পড়েছি। এসবই তার জাদুর খেলা। এরপর মন্ত্রবলে ডাইনিটা হয়তো আমাদের ওইরকম গাছপালা করে ফেলবে। আমাদের আর মানুষ হয়ে দেশে ফেরা হবে না।
প্রিয়বর্ধন, তুমি কান করে শোনো তো! বেহালার মতো সুর শুনতে পাচ্ছ না?
প্রিয়বর্ধন শুনতে শুনতে বলল, তা তো পাচ্ছি! ওই তো ডাইনির জাদু।
সকালে বনের ভেতর অর্কেস্ট্রার সুর শুনে তুমি গির্জা খুঁজতে গিয়েছিলে। গম্ভীরভাবে বললুম—বোকা কোথাকার! এখনও কি তুমি বুঝতে পারছে না এটা কোন দ্বীপ?
প্রিয়বর্ধন আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর নড়ে বসল। তার মুখটা কেমন যেন জ্বলে উঠল কী আভায়। দম আটকানো গলায় সে বলে উঠল, জয়ন্ত, জয়ন্ত! তবে কি এই সেই কোহাও রঙ্গো-রঙ্গো? আমরা কি তাহলে সত্যি কিওটা দ্বীপে বসে আছি?
হ্যাঁ, প্রিয়বর্ধন।
প্রিয়বর্ধনের পাগলামি ঘুচে গেল সঙ্গে সঙ্গে। উত্তেজনা দমন করে সে আমার হাত ধরে টানল। চাপা গলায় বলল, তাহলে আর দেরি না করে এস, আমারা রোজারিওর গুপ্তধন খুঁজে বের করি। চুপচাপ বসে থাকার মানে হয় না, জয়ন্ত। তাছাড়া যা শুনেছি, এই ভূতুড়ে দ্বীপে বেশিদিন মানুষ বাঁচতে পারে না। সবুজ রোগে মারা যায়।
সবুজ রোগ কী?
সে এক সাংঘাতিক অসুখ। সারা শরীর সবুজ হয়ে যায়।
অমনি আমার মনে পড়ে গেল, রুবিদ্বীপের জেলেদের গায়ে সবুজ অ্যালার্জি হওয়ার কথা শুনেছিলুম। এবার বুক কেঁপে উঠল। প্রিয়বর্ধন আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিল। বললুম, কোথায় যাচ্ছ এমন করে?
প্রিয়বর্ধন তেমনি চাপা স্বরে বলল, এবেলা থেকেই কাজ শুরু করা যাক। প্রথমে সারা দ্বীপের চৌহদ্দি দেখে নিই এস। চারদিক ঘুরে একটা ম্যাপ তৈরি করা দরকার। তারপর…
বাধা দিয়ে বললুম, ম্যাপ আঁকবে কিসে? কাগজ কলম তো নেই।
মাটির ওপর বা বালিতে আঁকব। সে তুমি ভেবো না। প্রিয়বর্ধন উৎসাহের সঙ্গে বলল। তারপর শুরু হবে তন্নতন্ন খোঁজা। এক ইঞ্চি জায়গা বাদ রাখব না।
আমার অবাক লাগছিল ভেবে, পৃথিবীতে কতরকম মানুষ আছে তাহলে! এই এক আশ্চর্য জনমানুষহীন দ্বীপ, যেখানে গাছপালা গান গায়, যেখানে গাছপালা প্রাণীদের মতো সজাগ, মানুষের মতোই তার দয়ালু এবং ফল তুলে দেয় ক্ষুধার্তের ঠোঁটে—এমন বিচিত্র এক ভূখণ্ডের বিস্ময়কর ঘটনাবলীর দিকে প্রিয়বর্ধনের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে লুকানো সোনাদানার প্রচণ্ড লোভে অস্থির হয়ে উঠেছে। বিড়বিড় করছে, রোজারিওর গুপ্তধন! রোজারিওর গুপ্তধন!