আর ওই ফলের গাছটার মধ্যে এমন কোনও উপাদান আছে, আমার শরীরের কোনও উপাদান যাকে আকর্ষণ করতে পারে। হয়তো আমার মুখের ভেতর সেই আকর্ষণ জিনিসটা আছে—চুম্বকের মতো তার টান।
আমার সাধারণ বুদ্ধিতে এইসব ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেললুম। সেই চিৎকার-চেঁচামেচির একটা ব্যাখ্যা আগেই এসেছে। এ বিশ্বের স্পেস বলতে যা বোঝায়, তা কিন্তু আদতে শূন্য নয়। আধুনিক বিজ্ঞানীর মতে, শূন্যস্থান বলে কিছু নেই। আর স্পেসে সব ধ্বনি আসলে স্পন্দনের তরঙ্গরেখা হয়ে অনন্তকাল আঁকা থেকে যায়। তেমনি সব দৃশ্যের চিত্ররূপও হয়তো স্থানকালব্যাপী অক্ষয় হয়ে থাকে। হিরোশিমায় অ্যাটম বোমা পড়ার সময়কার দৃশ্যগুলি পরবর্তী সময়ে বহুরাত্রে ভেসে উঠতে দেখা গেছে। ঠিক তেমনি করে বহু বছর আগের কোনও চিকার এই কিওটা দ্বীপের উদ্ভিদের কোষে কোষে তরঙ্গরেখা হয়ে গ্রামোফোন রেকর্ড বা ক্যাসেট টেপের মতো আঁকা হয়ে গেছে। কোনও কোনও সময় প্রাকৃতিক কারণেই রেকর্ডগুলি বেজে ওঠে। প্রকৃতিতে তো সত্যি করে ধ্বংস বলে কিছু নেই। একদিক থেকে যা ধ্বংস, অন্যদিক থেকে তাই সৃষ্টি। কোনও কিছু শূন্যে নিঃশেষিত হওয়ার নয়। সবকিছুর রূপান্তর আছে, ধ্বংস নেই।
কিন্তু কবে কতবছর আগে কে কাকে নিষেধ করেছিল স্টপ ইট বলে? কী করছিল অন্য লোকটি যে, তাকে থামতে বলতে হয়েছিল? আর কেই বা আই মাস্ট কিল ইউ বলে হিংসায় গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কার ওপর? তারা কারা? ভাষা শুনে মনে হয় তারা ইংরেজ। নিশ্চয় দ্বীপের কোথাও তাদের কোনও চিহ্ন এখনও খুঁজে পাওয়া যাবে। প্রিয়বর্ধন বলেছিল, এই দ্বীপে নাকি জলদস্যুদের গুপ্তধন লুকানো আছে। তারা কি একদল জলদস্যু? প্রবাল পাঁচিলে ধাক্কা লেগেই কি জাহাজ ড়ুবি হয়ে তারা এই দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিল?
হঠাৎ কোথায় ক্ষীণ সুরে মাউথ অর্গান বেজে উঠল। আমি আর বসে থাকতে পারলুম না। সুর লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলুম আবছা অন্ধকারে। সুরটা আসছে সোজাসুজি দক্ষিণ দিক থেকে। বিচ ধরে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে তাকালাম। তারপর চেঁচিয়ে বললুম, কে তুমি?
বাজনা থেমে গেল। কয়েকবার অকারণে ডাকাডাকি করে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেলুম। জলের ধারে পৌঁছতেই কালো একটা জিনিস চোখে পড়ল। একটু ঝুঁকে দেখেই চমকে উঠলুম। মানুষই বটে। অমনি মনে হল, প্রিয়বর্ধন নয় তো? প্রিয়বর্ধন হতেও পারে, নাও পারে। কিওটা দ্বীপে সব কিছু উলটোপালটা ব্যাপার।
কিন্তু আজ সারাটা দিন একটা অদ্ভুত মানসিকতা নিয়ে কাটিয়েছি। প্রিয়বর্ধনের কথা যেন ভুলেই গিয়েছিলুম। কদাচিৎ তার কথা মনে পড়লেও আমল দিইনি। আসলে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থেকেছি। ইশ! কী অকৃতজ্ঞ আমি! আমি দিব্যি তীরে পৌঁছুতে পারলুম আর সে-বেচারা কোথায় অসহায় হয়ে ভেসে গেল—তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা দূরে থাক, তাকে খুঁজে দেখার চেষ্টাও করলুম না।
নিজের ওপর খাপ্পা হতে নিঃসাড় দেহটার গায়ে হাত রাখলুম। বুকে স্পন্দন অনুভব করে বোঝা গেল, যাই হোক, লোকটা মরেনি। কিন্তু এই অন্ধকারে যে প্রিয়বর্ধন কি না বোঝার উপায় নেই। লোকটিকে কিছুক্ষণ উত্তাপ দিতে পারলে তার জ্ঞান ফিরে আসবে। কিন্তু অন্ধকারে শুকনো কাঠ খুঁজে আনাই সমস্যা। পা দুটো জলে এবং শরীর ডাঙায় পড়ে আছে লোকটার। ঢেউ এসে তার পায়ের ওপর আছড়ে পড়ছে। তবে অনুমান, জোয়ার ও ভাঁটার মাছামাঝি সময়ে লোকটা এখানে পৌঁছেছে। কিংবা এমনও হতে পারে ঢেউয়ে ভেসে এসেছে। আবার ভেসে যেতে পারে জোয়ারের টানে।
বালির ওপর তাকে টানতে টানতে উঁচু জায়গায় নিয়ে গেলুম। তারপর কী করা যায় ভাবছি, হঠাৎ লোকটা অস্পষ্ট শব্দ করল।
তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে চেতনা ফেরানোর চেষ্টা করলুম। কিন্তু আর কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।
তাকে ফেলে চলে যেতে পারি না—আর যাবই বা কোথায়? একটু তফাতে আমি বালির ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়লুম। অচেতন হোক, কিংবা মরাই হোক, জনমানহীন দ্বীপে মাঝে মাঝে ওইসব ভৌতিক চিৎকার আর বাজনার মধ্যে অন্তত একজন মানুষের কাছে শুয়ে থাকাটা অনেক ভাল। মনে জোর পাওয়া যায়।
ঘুম ভাঙল রোদের তাপ লেগে। সঙ্গে সঙ্গে আমার সঙ্গীর কথা মনে পড়ল। ধুড়মুড় করে উঠে। দেখি, তার পাত্তা নেই।
এ-তো ভারি ভয়ের কথা! কোনও জন্তুজানোয়ারে তুলে নিয়ে যায়নি তো? এদিকে ওদিকে তাকিয়ে তাকে খুঁজছি, সেই সময় অজানা ভাষায় একটা চেঁচামেচি কানে এল! ঝটপট উঠে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল, ঘাসের মাঠে দু-হাত ওপরে তুলে চাঁচাতে চাঁচাতে এদিকেই দৌড়ে আসছে আমার মতো ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক পরা এক পাগলাটে মূর্তি এবং সে আর কেউ নয়, শ্রীমান প্রিয়বর্ধন!
আমাকে দেখে সে চেঁচিয়ে উঠল আগেকার মতো ভাঙাভাঙা ইংরেজিতে—পালাও, পালাও।
দৌড়ে আমার পাশ কাটিয়ে সে জলে ঝাঁপ দেওয়ার উপক্রম করলে আমি তাকে ধরে ফেললুম। প্রিয়বর্ধন হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ভূত! ভূত! এ দ্বীপে ভূতের আস্তানা আছে, জয়ন্ত!
তাকে ধাতস্ত করতে বেগ পেতে হল। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করার পর আগাগোড়া মোটামুটি সব ঘটনা বললাম। সে কানখাড়া করে শুনে একটু হাসল। তোমার সঙ্গে আমার ভাগ্য জড়িয়ে গেছে। তবে তুমি ওই যে বললে, সারা রাত আমাকে চিনতে পারনি—এটা তোমার উচিত হয়নি, জয়ন্ত। আমি হলে ঘোর অন্ধকারেও তোমাকে ছুঁয়েই টের পেতুম। সূর্যের তাপ পেয়ে আমার জ্ঞান ফিরে দেখি, পাশে তুমি। আমি তো হতভম্ব একেবারে। ঘুমোচ্ছ দেখে আর জাগালুম না। জলটা যা ঘোলা, একটাও মাছ দেখা গেল না। তখন ওদিকে গেলুম, দেখি কিছু খাদ্য জোগাড় করা যায় নাকি। অন্তত শুকনো নারকোল গোটাকতক। কিন্তু এমন অখাদ্য দ্বীপ কে কবে দেখেছে, সেখানে নারকোল গাছের বালাই নেই। খানিকটা গিয়ে চোখে পড়ল একটা আপেল গাছ! যেই হাত বাড়িয়েছি, বললে বিশ্বাস করবে না, গাছের একটা ছিপছিপে ডাল সাঁই করে চাবুকের মতো আমার ওপর পড়ল। তারপর আবার একটা—আবার! লোক নেই, জন নেই—অথচ আমাকে ছিপটি মারছে… বাক্স!