সারা বনভূমি জুড়ে কিল এবং হেল্প কথা দুটো জড়িয়ে যেতে যেতে প্রতিধ্বনিত হতে হতে ছড়িয়ে পড়ছে। উত্তেজনায় আবার সেই উন্মাদনা আমাকে পেয়ে বসল। একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে জঙ্গলের ভেতর দৌড়ুতে শুরু করলুম। লোকটাকে বাঁচানোর জন্য আমি মরিয়া।…
১১. স্বপ্ন কিংবা স্বপ্ন নয়
ফাঁকা মাঠে গিয়ে পড়তেই হত্যাকারীর অমানুষিক গর্জন আর আক্রান্তের আর্তনাদ ক্রমশ মিলিয়ে গেল। অমনি আমার সম্বিৎ ফিরে এল। মনে পড়ে গেল সকালের সেই স্টপ ইট বলে ধমকের কথা। কিওটা দ্বীপে এইসব অদ্ভুত চিৎকার-চেঁচামেচি যে নিছক অতীতের কিছু ঘটনার অলীক প্রতিধ্বনি, তাতে ভুল নেই। হাতের পাথরটা ফেলে দিলাম।
কিন্তু অবাক লাগল নিজের এই উত্তেজনা আর উন্মাদনা দেখে। আমি কি খুব শিগরির পাগল হয়ে যাব? এই অত্যাশ্চর্য দ্বীপ আমাকে বদ্ধ পাগলে পরিণত করে ফেলবে, যদি না আমি সচেতন থাকি প্রতিমুহূর্তে। খাড়ির ধারে যেতে যেতে সকালে করুণ বেহালার সুর শুনে আমি তো কেঁদে ফেলেছিলুম! ভাগ্যিস প্রচণ্ড খিদে আমার মানসিক সুস্থতা ফিরিয়ে দিয়েছিল।
শান্তভাবে দাঁড়িয়ে ভাবছিলুম, আমি জয়ন্ত চৌধুরি। কলকাতার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক। ঘটনাচক্রে এই ভূতুড়ে দ্বীপে এসে পৌঁছেছি। আমার মাথাটা ঠিক রাখতেই হবে। এইসব বিচিত্র, প্রাণবন্ত ও সচেতন উদ্ভিদের ব্যাপার-স্যাপার খুঁটিয়ে জানতে এবং বুঝতে হবে। ভড়কে যাওয়া চলবে না।
আমার খুব কাছেই একটা ফুট চারেক উঁচু চওড়া পাতাওয়ালা ঝোপ ছিল। তার ডগায় বেগুনি রঙের থোকা থোকা ফুল। ফুলের উঁটিগুলো শুড়ের মতো দেখতে। হঠাৎ সুড়সুড়ি খেয়ে চমকে উঠে দেখি, কয়েকটা ফুলওয়ালা শুড় আমার ছেড়া শার্টের ভেতর দিয়ে পাঁজরে ঘষা খাচ্ছে। একটু সরে গেলুম। শুড়গুলোও আমার নাগাল পেতে ঘুরে এল। কী করে দেখার জন্য আমি হাত বাড়িয়ে দিলুম। আমার হাতটা পেঁচিয়ে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে ছাড়িয়ে নিলুম এক ঝটকায়। তারপর দেখি ঝোপটা ভীষণ কাঁপতে কাঁপতে এপাশে ওপাশে লুটোপুটি খাওয়ার তাল করছে।
সঙ্গে সঙ্গে টের পেলুম, ঝোপটা তার নিঃশব্দ ভাষায় খিলখিল করে হাসছে। আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করছিল বুঝি—আমার ভয় পাওয়া দেখে এখন হেসে বাঁচে না। আমি ভেংচি কেটে বললুম, লজ্জা করে না হাসতে? আমার মতো দুর্ভাগার সঙ্গে রসিকতা করতে একটুও বাধছে না?
রাগ করে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা তফাতে চলে গেলুম। এখানে পায়ের তলায় ঘাস যেন ঘাস নয়। মখমলে মোড়া ফোম। কয়েক টুকরো পাথরের ভেতর থেকে একটা লিকলিকে গাছ। উঠেছে—আমার মাথার সমান উঁচু। পাতাগুলো দেবদারুর মতো দেখতে। গাছটায় পিচফলের মতো অজস্র ফল ধরে আছে। দেখা যাক, এই গাছটা আমাকে একটা ফল দেয় নাকি।
ভাবা মাত্র গাছটা আমার দিকে ঝুঁকে এল এমনকি একটা ফলে ভর্তি ডাল এগিয়ে এসে আমার ঠোঁট স্পর্শ করল। মুখ সরিয়ে নিতে গিয়ে মনে হল, এই দয়ালু বৃক্ষ মশায় আমাকে যখন তার ফল খাওয়াতেই চাচ্ছে, তখন প্রত্যাখ্যান করাটা উচিত হবে না। তাকে আরও পরীক্ষা করার জন্য আমি হাঁ করলুম। একটা থোকা এসে আমার মুখের ভেতর ঢুকে গেল।
আহা, কী অপূর্ব স্বাদ ফলগুলোর। কয়েক থোকা ফল সাবাড় করে গাছটাকে সাষ্টাঙ্গে একেবার প্রণিপাত করে ফেললুম। তারপর দারুণ স্ফূর্তি লাগল। খোলা বিরাট মাঠটায় দৌড়তে শুরু করলাম। কখনও ডিগবাজি খেয়ে, কখনও ছুটোছুটি করে একটি ধেড়ে শিশু হয়ে পাখির ঝকের পেছনে তাড়া করে সে এক উদ্দাম স্ফূর্তি।
তারপর গান গাইতে ইচ্ছে করল। তার পরে গান ধরলুম—মাথায় যা এল, সেই কথা দিয়ে অগড়ুম-বাগড়ুম একখানা বিকট গান।
স্বগ্গে এসে গেছি ভাইরে
স্বগ্গে এসে গেছি হো হো স্বগৃগে এসে গেছি।
কতক্ষণ পরে আমার সম্বিৎ ফিরল। থমকে দাঁড়ালুম। এ আমি কী করছি। সর্বনাশ পাগলামির লক্ষণ যে ফুটে বেরুচ্ছে আমার আচরণ! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। কখন বিকেলে গাঢ় পাটুকিলে রঙের রোদ ফুরিয়ে ধূসরতা ঘনিয়ে উঠেছে। চারপাশে নীলাভ কুয়াশা জমে উঠেছে। আমার পায়ের কাছে ঠাহর করে দেখি, ব্যুমেরাং গড়নের কাঠপোকাদের দল ঘাসে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে। আঁতকে উঠে সরে গেলুম।
তারপর সোজা পুবের বিচের দিকে হনহন করে চলতে থাকলুম। ওদিকটা ফঁকা। সমুদ্র জুড়ে আবছা লালচে আভা মিলিয়ে গেল। প্রবাল পাঁচিলের ভাঙা অংশটার ওপারে দিগন্ত রেখা আর চেনা যাচ্ছিল না। কিন্তু বাতাসটা কেমন যেন ঈষদুষ্ণ ফুলের সুন্দর গন্ধ সন্ধ্যার মুখে আরও ঝাঁঝালো হয়ে উঠেছে। ওপর দিকটায় পাথরের চওড়া চাতাল মতো একটা জায়গায় বসে পড়লুম।
শুঁড়ের মতো শিসওয়ালা সেই বেগুনি ফুলের আচরণের কথা মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল। ফলদাতা শীর্ণ গাছটার কথাও। এর একটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা থাকা উচিত বৈকি। কোনও লতানে গাছ কোনও জিনিসকে আঁকড়ে ধরে পেঁচিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করে। এতে তার বহুক্ষণ সময় লাগে। এমন যদি হয়, লতানে গাছটার এই গতিকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কী হবে? ওই বেগুনি ফুলের শিসের মতোই আচরণ করবে না কি? তাকে ঝাকুনি দিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছিলুম মনে। পড়ছে। একটা ব্যাখ্যা এ থেকে মেলে। আমার শরীর থেকে খানিকটা গতিশক্তি সঞ্চারিত হয়েছিল গাছটার মধ্যে। তার সঙ্গে যদি তার নিজের গতিশক্তি যোগ করা হয়, তাহলে দ্বিগুণ গতির চাপে সে কঁপবে, কিছুক্ষণ ধরে আন্দোলিত হবে। এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার।