খাদ্যের সন্ধান আমাকে করতেই হবে। বরং সমুদ্রের ধারে গিয়ে দেখি, যদি মাছ মারতে পারি।
গাছপালার ফাঁক দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছিল। এদিকটায় জঙ্গল খুব ঘন। অসংখ্য গাছ বুড়ো হয়ে ভেঙে পড়েছে কালক্রমে। তার ওপর আবার গাছের চারা গজিয়েছে। এতক্ষণে পাখির ডাক কানে এল। তাহলে কিওটাতে প্রাণীও আছে! মনে হল, দ্বীপের পাখিরা আমার মতো এক আগন্তুককে দেখে যেন ভয় পেয়ে এতক্ষণ আড়ালে সরে গিয়েছিল। ক্রমশ সাহস পেয়ে তারা একে একে বেরিয়ে আসছে এবং মন খুলে গান গাইতে শুরু করেছে। কিন্তু চেষ্টা করেও একটা পাখি আমার চোখে পড়ল না।
তারপর একটা ময়াল জাতীয় প্রকাণ্ড সাপকে একটা গাছের ডালে ঝুলতে দেখলুম! হ্যাঁ—সাপও আছে। কিওটা তাহলে মানুষের পক্ষে একটা নিরাপদ জায়গা নয়। এক দৌড়ে সমুদ্রের ধারে গিয়ে হাজির হলুম। এবার সাপের কথা ভেবে বুক ঢিপঢিপ করছিল।
সূর্যের অবস্থান দেখে বুঝতে পারলুম এদিকটা উত্তর দিক। আমি দ্বীপে এসেছি পূর্বদিক থেকে। সামনে বিস্তীর্ণ জলের পর প্রবাল পাঁচিল কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার বাঁদিকে টানা বিচ। ক্রমশ ঘুরে গেছে দক্ষিণে। বিচের বাঁকের মুখে পাহাড়ি খাড়ি। এখানে জলটা তত পরিষ্কার নয়। ঢেউয়ের চোটে বালি ভেসে উঠেছে। চাপচাপ শ্যাওলা জাতীয় গাছ আছে জলের ভেতর। তাই ভাবলুম, খাড়ির জলটা পরিষ্কার হতে পারে। ওখানে পাথরের ফাঁকে নিশ্চয় মাছের ঝাঁক চোখে পড়বে।
যেতে যেতে বাঁদিকে জঙ্গলের ভেতর বেহালার বাজনা শুনে থমকে দাঁড়ালুম। সত্যি বাজছে, নাকি কানের ভুল, ঠিক করতে পারলুম না। কিন্তু বড় করুণ সুর সেই অলীক বেহালার। এ এক আশ্চর্য মায়াজগৎ যেন, যেখানে যখন তখন বেজে ওঠে গম্ভীর, অর্কেস্ট্রাধ্বনি কিংবা বেহালা সুর। বিচিত্র অনুভূতি জেগে ওঠে মনে। আবেগে হৃদয় দুলতে থাকে। সুরটা শুনতে শুনতে আমার চোখে জল এসে গেল।
কিন্তু সব মিথ্যা পেট সত্য। বহুকাল আগেই পথের ধারে এক দেহাতী ম্যাজিশিয়ানের মুখে খেলার শেষে শুনেছিলুম এই পরম সত্য কথাটা। খিদে আর তেষ্টার কথা সম্ভবত যত ভাবা যায়, তত বেড়ে ওঠে। ক্যারিববার রুটি-জ্যাম-সসেজ সেই মধ্যরাতে সমুদ্রের বুকে সাবাড় করেছি। এখন সেকথা ভেবে জিভে জল আসছিল। অদৃশ্য বেহালাবাদক সেটা টের পেয়েই যেন হঠাৎ বাজনা বন্ধ করে দিল।
বাঁকের মুখে খাড়ির ধারে এসেই মন নেচে উঠল। পাহাড়ের মাথায় একখানে সাদা একটা রেখা দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলুম। না—চোখের ভুল নয়। ওটা একটা ঝরনা। সরু ফিতের মতো নেমে এসে লোনা খাড়ির জলে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে।
এরপর নিজের তৎপরতায় নিজেরই অবাক লাগছিল। খাড়িতে বড় বড় পাথর পড়ে আছে। তার ফাঁকে অতি স্বচ্ছ জলে ম্যাকারেল জাতীয় মাছের ঝাঁক খেলা করছিল। পাথর মেরে একটাকে বধ করতে দেরি হল না। মাছটার ওজন কমপক্ষে শদুই আড়াই গ্রাম না হয়ে যায় না।
প্রিয়বর্ধনের পদ্ধতিতে দু- টুকরো শুকনো কাঠ ঘষে আগুন জ্বেলে মাছটা পুড়িয়ে রাক্ষসের মতো খেলুম বিচে বসে। তারপর পাহাড়ে চড়া শুরু হল। মাউন্টেনিয়ারিং ট্রেনিং নেওয়াটা এভাবে কত জায়গায় কাজে লেগেছে বলার নয়। ঝরনার কাছ ঘেঁষে একটা চাতাল মতো জায়গা দেখতে পেলুম। সেখানে পৌঁছে প্রাণ ভরে জল খেয়ে দ্বীপের দিকে ঘুরে দাঁড়ালুম।
আগের দ্বীপটার চেয়ে এই দ্বীপটা বহুগুণে বড়। উঁচু থেকে ভূ-প্রকৃতি ঠাহর হচ্ছিল। মাঝে মাঝে ভোলা মাঠ, আবার বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসের জমি। পাখির ঝাক চোখে পড়ছিল। এই তাহলে সেই আশ্চর্য দ্বীপ কিওটা।
এবার একটু ভাবনায় পড়ে গেলুম। আমি হয়তো চেষ্টা করলে জর্জ ব্যুগেনভিলির মতো ভেলা তৈরি করে সমুদ্রে ভাসতে পারি—কোনও জাহাজ দৈবাৎ আমাকে দেখে উদ্ধার করলেও করতে পারে, নয়তো হাঙরের পেটে হজম হয়ে যেতে পারি। এই আশ্চর্য আবিষ্কার আমি লাগাতে পারব না। আমি বিজ্ঞানী নই। কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের মতো সাধারণ বিজ্ঞান সম্পর্কেও আমার তত বোধবুদ্ধি নেই। তাহলে এই অবিষ্কার মানুষের অতীতকালের এক কিংবদন্তিকে পুষ্ট করা ছাড়া আর কী কাজে লাগবে?
হতাশা পেয়ে বসল ক্রমশ। কর্নেলের কথা ভাবতে থাকলুম। ধুরন্ধর প্রাজ্ঞ বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি এখন কোথায়? আমার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া নিয়ে হয়তো সূত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে হন্যে হচ্ছেন রুবিদ্বীপে। কিওটা পৌঁছনোর যত চেষ্টা করুন, দ্বিতীয় কাত্তিটার অভাবে পথ খুঁজে পাবেন না—এটা নিশ্চিত।
শুধু একটাই আশা। কর্নেল চিরদিন রহস্যময় অজানার সন্ধানে পাড়ি জমাতে পিছপা হননি। অসাধারণ তাঁর বুদ্ধির চাতুর্য। তাঁর মেধা তুলনাহীন।
ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম কখন সেই চাতালে। ঘুম ভেঙে দেখি, বিকেল হয়ে গেছে। কী লম্বা ঘুম না ঘুমিয়েছি তাহলে। মাছটা দেখছি খিদে মেটাতে অদ্বিতীয়। কী মাছ কে জানে, মনে হচ্ছে খিদে জিনিসটা চিরকালের মতো শেষ হয়ে গেছে। শরীর ঝরঝরে লাগছে। স্ফূর্তিতে পেশি, চনমন করছে! চাতাল বেয়ে সমুদ্রের বিচে নামতে থাকলুম। কেউ আমাকে দেখলে পাগল ভাবতে পারত। ফর্দাফাই পোশাক, খালি পা, রুক্ষ চিটচিটে চুল।
নিচে বড় বড় পাথরের টুকরোর ভেতর গাছপালা আর ঝোপ গজিয়ে রয়েছে। সেখানে যেই পৌঁছেছি, ডান দিকে জঙ্গলের ভেতর কেউ চেরা গলায় আর্তনাদ করে উঠল—ও ডোন্ট কিল মি! তারপরই কেউ গর্জন করে বলল, মাস্ট কিল ইউ! কিল ইউ…কিল ইউ.এবং আর্তনাদের পর আর্তনাদ-হেল্প! হেল্প! হেল্প!