আর্কিমিডিসের ইউরেকা বলে চিৎকার করে ছোটাছুটি করার ভঙ্গিতে কিওটা! কিওটা! বলে। চেঁচাতে চেঁচাতে এবং দুহাত তুলে লম্ফঝম্ফ করতে করতে দৌড়ে গেলুম। অপেক্ষাকৃত ফাঁকা তংশ দিয়ে ঢুকে একটা খোলামেলা সবুজ মাঠের ওপর ধপাস করে পড়ে বারকতক গড়াগড়ি খেলুম। তারপর আবার দৌড়ুতে শুরু করলুম। আমি সত্যি সত্যি বদ্ধ পাগলের মতো চিঙ্কার করছিলুম, কিওটা! কিওটা! কিওটা!
হ্যাঁ, এই সেই আশ্চর্য দ্বীপ কিটা। কোথাও রঙ্গো-রঙ্গো পুঁথিতে বর্ণিত স্পিকিং উডস—কথা বলা বনের দেশ। এই সেই প্রাচীনযুগের নাবিকদের কিংবদন্তির দ্বীপ সঙ্গীতকারী বৃক্ষের বাসস্থান কিওটা!
ঘাসের ভেতর লুকিয়ে থাকা পাথরে ঠোক্কর খেয়ে ছিটকে পড়লুম। সঙ্গে সঙ্গে উন্মাদনাটা কেটে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়ালুম। নিজের পাগলামির কথা ভেবে খারাপ লাগল। এবার আমার সবচেয়ে জরুরি জিনিস হল মানসিক সুস্থতা।
ঘাসের মাঠটা বিশাল। এখানে-ওখানে উজ্জ্বল নানা রঙের পাথর ছড়িয়ে আছে। কোথাও একলা কোনও গাছ বা ঝোপ, কোথাও নিবিড় উঁচু ঘাস। একটা নিচু ঝাকড়া গাছে আপেলের মতো ফল ধরে আছে দেখে সেদিকেই এগিয়ে গেলুম। ওগুলো ব্রেডক্রুট বলে মনে হচ্ছিল। কয়েক পা যেতেই এক অবাক কাণ্ড ঘটল। রুবিদ্বীপে রাজাকোর জাদুঘরে ব্যুমেরাং-আকৃতির যে জ্যান্ত জিনিসটা দেখেছিলুম, কর্নেলকথিত সেই কাঠকার-এর একটা ঝক ঘাসের ভেতর থেকে লাফিয়ে উঠল। তারপর দল বেঁধে লাফাতে লাফাতে উঁচু ঘাসবনের ভেতর গিয়ে ঢুকল।
ফলের গাছটার তলায় চওড়া বেদির মতো পাথর। সেটাতে চড়ে একটা ফল ভাঙতে হাত বাড়িয়েছি, একটা হাতে ডাল ধরে নুইয়ে রেখেছি, অমনি ডালটা আমার হাত ছাড়িয়ে সটান সোজা হয়ে গেল। নাগাল পেলুম না। তারপর যে ডালটা ধরতে যাই, একই কাণ্ড। গাছটা প্রাণীর মতো জ্যান্ত এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালনে সক্ষম দেখে হতবাক হয়ে গেলুম। একটু পরে গাছটার সবগুলো ডাল সোজা হয়ে গেল। প্রকাণ্ড এবং বেঁটে তালগাছের মতো দেখাল গাছটাকে। আমি তার দিকে চেয়ে কাকুতিমিনতি করে বললুম, লক্ষ্মী ভাইটি! বড্ড খিদে পেয়েছে। অমন কোরো না।
আমার দুর্ভাগ্য, মানুষের ভাষা ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারলুম না। ইশারা-ইঙ্গিত করে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে সত্যি আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। কিন্তু হতচ্ছাড়া গাছটা তেমনি সাধুর মতো ঊর্ধ্ববাহু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লোভনীয় রঙিন ফলগুলি আমার নাগালের বাইরে উঁচুতে দুলতে থাকল।
এতক্ষণে আমার মাথায় এল, এর মধ্যে হয়তো আজগুবি ব্যাপার নেই। লজ্জাবতী লতার মতো কোনও প্রকৃতিক নিয়মেই গাছটার মধ্যে সংকোচন ঘটেছে আমার ছোঁয়ায়। গাছটার খুঁড়িতে খোঁচাখোঁচা কাটাও রয়েছে। একটু তফাতে সরে গিয়ে একটুকরো পাথর কুড়িয়ে নিলুম। পাথরটা ছুঁড়তে যাচ্ছি, হাতের তালু ছ্যাক করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে পাথরটা ফেলে দিলুম। তারপর দেখি, ও হরি! ওটা আদতে পাথরই নয়—ধূসর রঙের একটা প্রজাপতি। ডানা গুটিয়ে পড়েছিল ঘাসের ফাঁকে। ভারি অদ্ভুত প্রজাপতি তো!
এবার কালো রঙের সত্যিকার একটা পাথর কুড়িয়ে নিলুম। পাথরটা ফল লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলুম। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। ফলগুলোও যেন অসম্ভব ধূর্ত। পাথরের লক্ষ্যপথ থেকে কেমন ঝটপট সরে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিয়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেলুম। এতক্ষণে আবিষ্কার করা গেল, এই দ্বীপে নারকোল গাছ নেই। শুধু তাই নয়, এখানকার সব গাছ—সমস্ত উদ্ভিদ যেন অন্যরকমের। কোনওটাই আমি এর আগে দেখিনি কোথাও। এমনকী যে ঘাসগুলো আমি মাড়িয়ে এলুম, সেগুলোও আমার অচেনা। যত রকমের ঘাস আজীবন দেখেছি, তার সঙ্গে কোনও মিল নেই এ ঘাসের। ভেলভেটে বোনা পুরু এবং নকশাদার এই ঘাসের সৌন্দর্য বিস্ময়কর। লক্ষ্য করে দেখলাম, কোথাও রুগ্ণ, হাড়জিরজিরে কোনও গাছ নেই। প্রত্যেকটি সবল, নিটোল, বর্ণাঢ্য—যেন ছবিতে যত্ন করে আঁকা।
একটা প্রকাণ্ড গাছের গায়ে হাত রেখেই চমকে উঠলুম। কোনো প্রাণীর গায়ে হাত রাখলে যে। অনুভূতি অবিকল। বৃক্ষের প্রাণ আছে সে তো জানি। কিন্তু এত প্রাণ! এত তীব্র চেতনা! আমার দিকে তাকিয়ে আছে তীব্র চেতনাসম্পন্ন উদ্ভিদরূপী প্রাণীশূথ যেন।
একটা ঝোপে আঙুরের গুচ্ছ গুচ্ছ ফল দেখে সেদিকে ব্যস্তভাবে ছুটে গেলুম। গোলাপি রঙের সুন্দর ফলগুলি রসে টলটল করছিল। কিন্তু হাত বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল, কে যেন নিষেধ করছে।
কোনও কণ্ঠস্বর শুনিনি অস্বাভাবিক নির্জনতা ছমছম করছে চারদিকে। অথচ আমার মনে হল, আমার মাথার ভেতর ঝিঝি পোকার মতো শ্রুতিপারে এক অনুভূতিময় সুর একটা নিষেধাজ্ঞা শোনা যাচ্ছে। কে যেন বলছে, ওই সুন্দর ফলগুলো বিষাক্ত।
মন থেকে ধারণাটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলুম না। একি আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের বোধ? সঠিক বলা কঠিন। যে বোধ মানুষকে অনেক সময় বিপদের পূর্বাভাস দিয়ে সতর্ক করতে চায়, এ কি সেই বোধ? প্রাণীদের মধ্যে এই বোধ এখনও লুপ্ত হয়নি – প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষও হয়তো এই ক্ষমতার অধিকারী ছিল। কিন্তু সেই বোধ আমার মতো একজন সভ্য জগতের আধুনিক মানুষের মধ্যে টিকে আছে—নাকি কিওটা দ্বীপে পৌঁছনোর পর কোনও প্রকৃতিক নিয়মে তা ফিরে এসেছে। আমার মধ্যে?
ব্যাপারটা যাই হোক, ফলের ঝোপটার সঙ্গে আমার যেন একটা টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ ঘটছিল। আমি সেখান থেকে হতাশ হয়ে সরে গেলুম অন্যখানে।