নিশ্চয় কানের ভুল। তারপর আর কোনও ভূতুড়ে আওয়াজ আমি শুনিনি। কিন্তু নাবিকরা আর এক পা বাড়াতে রাজি নয়। তারা আমাকে অগ্রাহ্য করে বোটে গিয়ে বসে রইল। ডাঃ স্মিথ আর আমি সতর্কভাবে ছোট্ট দ্বীপটা দুপুর পর্যন্ত ঘুরলাম। জনপ্রাণীটি নেই। ফেরার সময় ডাঃ স্মিথ বললেন, একবার যেন কাদের অস্পষ্ট ফিসফিস কথাবার্তা শুনেছেন। ভদ্রলোক বড় কল্পনাপ্রবণ।…
এখন রাত দশটা। রেজিলিউশন দক্ষিণ মহসাগরে ভেসে চলেছে আন্টার্কটিকার দিকে। কিওটা দ্বীপের ব্যাপারটা গাছপালার মর্মরধ্বনি ছাড়া আর কিছু নয়। আমার ধারণা, স্টপ ইট কথাটা কানের ভুল, সম্ভবত কাঠঠোকরা জাতীয় পাখি শুকনো কাঠে ঠোকরাচ্ছিল এবং তা থেকেই ওই আওয়াজ। বিদ্রোহী নাবিক দুজনকে শাস্তি দিয়েছি। পাঁচ ঘা বেত এবং ২৪ ঘন্টা অনাহারের শাস্তি। ডাঃ স্মিথ একটু আগে বলে গেলেন, ওদের গায়ে নাকি সবুজ রঙের অদ্ভুত অ্যালার্জি বেরিয়েছে। সবকাজেই ওঁর বাড়াবাড়ি।–ক্যাপ্টেন টমাস কুকের লগবুক। 12. 12. 1772
***
কীলিং (Keeling) দ্বীপপুঞ্জে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর ফসিল খুঁজতে যাওয়ার সময় দ্বীপের এক বৃদ্ধ আমাকে কিওটা নামে অদ্ভুত একটা দ্বীপের কথা বলে। সেটা নাকি মাইল ষাটেক দক্ষিণে। সেই দ্বীপের গাছগুলো নাকি কথা বলে। অবান্তর ব্যাপার। সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বিগল জাহাজের ক্যাপ্টেন রবার্ট ফিরয় বদরাগী মানুষ। এমনিতেই আমার কাণ্ডকারখানা দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে আছেন। তাকে যদি বা রাজি করাতে পারি, নাবিকদের পারব না। কিওটার কথা শুনেই তারা বলেছে, ওই ভূতের দ্বীপ অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত তাই কিওটা যাওয়া হল না। মনে ক্ষোভ রয়ে গেল।
— চার্লস ডারউইন, এইচ এম এস বিগল 23, 2, 1835
***
উদ্ধারপ্রাপ্ত নাবিকের নাম জন হিক্স। তাকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে ভারত মহাসাগরে জাহাজ ড়ুবি হয়ে একটা দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে গাছপালা কথা বলে। তাকে খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল একটা গাছ। হিক্সের বিবৃতির সময় প্রখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড হোম উপস্থিত ছিলেন। তিনি কোনও মন্তব্য করেননি। হিক্স আরও একটা অদ্ভুত কথা বলে। একটা গাছের সঙ্গে তার নাকি বিয়েও হয়েছিল। ডাক্তারদের মতে লোকটি উন্মাদ রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তবে ব্রিটিশ জাদুঘরের কিউরেটারে ডঃ ফক্স বলেছেন, খ্রিস্টপূর্ব একহাজার অব্দে ফিনিসীয় নাবিকদের প্যাপিরাসে লেখা যে লগবুক আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে গর্জনকারী গাছের কথা আছে। কোনও সমুদ্রে একটি দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা সেই ভৌতিক গর্জন শুনতে পেত। তাই দ্বীপে নামার সাহস পেত না। ডঃ ফক্স আরও বলেছেন, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে লেখা গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস সঙ্গীতকারী বৃক্ষের কথা বলেছেন। চৌদ্দ শতকে বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো লিখেছেন, ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গভীর রাত্রে তারা সেখানে কোলাহল শুনতে পান। জাহাজ দ্বীপের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সারারাত আশ্চর্য সব শব্দ শোনেন। সকালে পোললা বোটে করে দ্বীপটিতে পৌঁছন। কিন্তু আর একপা এগোতে পারেননি। প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয় এবং হাজার হাজার মানুষ যেন তাঁকে গর্জন করে এগোতে নিষেধ করে। পোললা লিখেছেন, গাছগুলো থেকেই ওই গর্জন ভেসে আসছিল। বোটে ফিরে গেলে, আশ্চর্য ব্যাপার ঝড়টা তক্ষুনি থেমে যায়।…
—দি ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড, লন্ডন 7.9. 1981
***
…কোহাও রঙ্গে রঙ্গো। কথা বলা বন। প্রশান্ত মহাসাগরের পলিনেশীয় এলাকার ছোট্ট দ্বীপ ইস্টার আইল্যান্ডে বিশপ জোসেন নামে এক খ্রিস্টীয় যাজক গত শতকে একটি পুঁথি আবিষ্কার করেন। তাঁর লিপির সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার লিপির আশ্চর্য মিল। মেতেরো নামে তার স্থানীয় এক ভৃত্য পুঁথিটি পড়ে অনুবাদ করে দেয়। এই পুঁথির নাম কোহাও রঙ্গে রঙ্গো। এটি ইস্টার দ্বীপের আদিম অধিবাসীদের ধর্মীয় পুরাণ। এতে আছে এক অদ্ভুত বনের কাহিনী—যার গাছগুলো কথা বলতে পারত। তাদের উপাস্য দেবতার নাম ছিল রাঙ্গেতিয়া। তিনি আকাশের দেবতা। তার আশীর্বাদে গাছপালা কথা বলত মানুষের ভাষায়। বিশপ জোসেনের ধারণা, সেই কথা বলা বন বহু বছর আগে নির্মূল হয়ে গেছে কোনো কারণে।
-ইস্টার আইল্যান্ডের রহস্য : ই ডলফার, পৃষ্ঠা 5
প্যারিস ২০ জানুয়ারি—সম্প্রতি প্রখ্যাত অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন জর্জ ব্যুগেনভিলি তার সপ্তদশ নৌ অভিযানে আন্টার্কটিকা যাওয়ার সময় ঝড়ের মুখে পড়েন। জাহাজ ড়ুবে যায়। লাইফবোটের সাহায্যে ভাসতে ভাসতে সাত দিন পরে কোকোস দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপে ওঠেন। ক্যাপ্টেন ব্যুগেনভিলি জনহীন দ্বীপ থেকে গাছ কেটে ভেলা তৈরি করে সমুদ্র পাড়ি দেন। একমাস পরে কীলার দ্বীপে পৌঁছন। তিনি সেই নির্জন দ্বীপ সম্পর্কে এক অদ্ভুত বিবরণ দিয়েছেন। সেখানে নাকি গাছপালা মানুষের মতো কথা বলতে পারে।…
–রয়টার
ফাইল থেকে মুখ তুলে জর্জ ব্যুগেনভিলির দিকে তাকালাম। সায়েব মিটিমিটি হাসছিলেন।
০২. উদ্ভিদের গোপনকথা
আমার বৃদ্ধ বন্ধুকে ইদানীং ক্যাকটাস এবং অর্কিড-জাতীয় উদ্ভিদ নিয়ে কী সব বিদঘুটে ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেখতাম। একদিন গিয়ে দেখি, হেড-ফোন মাথায় এঁটে বসে আছেন এবং একটা অ্যামপ্লিফায়ার যন্ত্রের নব ঘোরাচ্ছেন। একটা অদ্ভুত আকৃতির নধর ক্যাকটাসের গায়ে পিন ফুটিয়ে রেখেছেন। পিনের মাথায় সূক্ষ্ম তামার তার বাঁধা। তারটা আরও একটা ক্ষুদে যন্ত্রের ভেতর দিয়ে এসে অ্যামপ্লিফায়ারে পৌঁছেছে। ক্ষুদে যন্ত্রটা জারে তরলপদার্থের ওপর ভাসছে। তারপর অবাক হয়ে দেখি, উনি চোখ বুজে থিরথির করে কাঁপতে লাগলেন। অমনি ভাবলাম, এই রে! বুড়ো নির্ঘাৎ তড়িতাহত হয়ে পড়েছেন।