ঝটপট ওর হাত থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে চোখে রাখলুম। দীর্ঘ আলো, রেখাটা প্রবাল বলয়। খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের ওপর। ডানদিকে অনেকটা জায়গা ভাঙা। আর ভেতর দিয়ে একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। দ্বীপের বুকে ঘন জঙ্গল। প্রথম আলোয় সবুজের জেল্লাও চোখে পড়ছিল।
প্রিয়বর্ধন করুণ মুখে বলল, আমদের বোট কোরাল রিফে গিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে গুঁড়ো হয়ে যাবে। কী তীব্র স্রোত দেখতে পাচ্ছ না জয়ন্ত?
বললুম, ওই ভাঙা জায়গায় বোট নিয়ে গেলে বেঁচে যাব। এস প্রিয়বর্ধন, বৈঠা নাও!
প্রিয়বর্ধন অনিচ্ছাসত্ত্বেও বৈঠা নিল। দুজনে প্রাণপণে বৈঠা টেনে বোটের মুখ প্রবাল পাঁচিলের ভাঙা অংশটার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলুম। যত এগিয়ে যাচ্ছি, তত প্রবাল পাঁচিলটা উঁচু মনে হচ্ছে। আন্দাজ শদুই মিটার দূরত্বে পৌঁছে যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। ছিটকে গিয়ে সমুদ্রে পড়লুম। জলে না পড়লে গুড়ো হয়ে যেত এই মরদেহ।
সাঁতার কেটে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলুম ভাঙা অংশটার দিকে। ভেসে থেকে প্রিয়বর্ধনকে খুঁজছিলুম। দেখি, সেও আমার মতো সাঁতার কাটছে। বুঝলুম ড়ুবো পাথরে ধাক্কা লেগে বোটটা ভেঙে-চুরে গেছে। ওলটপালট খেতে কাঠের বড় বড় ফালি ফেনার ভেতর মাছের মতো ভেসে চলেছে প্রবাল পাঁচিলের দিকে। ঢেউ ভাঙার গর্জন, ফেনা, জলোচ্ছ্বাস—চারদিকে যেন প্রলয় চলছে।
তারপর পায়ে শক্ত পাথর ঠেকল। সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে প্রিবর্ধনকে আর দেখতে পেলুম না। কিন্তু তার কথা ভাবতে গেলে নিজের প্রাণ বাঁচানো সংশয়তাছাড়া যাকে দেখতে পাচ্ছি না, তাকে উদ্ধার করব কী ভাবে? জলের ধাক্কায় পিছলে যাচ্ছি বারবার। হাঁচড়-পাঁচড় করে জল ভাঙা অংশটা পেরিয়ে গেলুম। এবার জলটা শান্ত-নিস্তরঙ্গ। সাঁতার কেটে বিচের দিকে এগিয়ে যেতে আর অসুবিধা হল না। মাথা ঘুরছিল। তখন পা ছড়িয়ে চিত হয়ে শুয়ে রইলুম।
আচ্ছন্ন অবস্থায় কতক্ষণ শুয়ে ছিলুম জানি না, এক সময় মনে হল কোথায় যেন অনেক দূরে চাপা গম্ভীর অর্কেস্ট্রা বাজছে। নিশ্চয় এই দ্বীপে কোনও গির্জা আছে। সেখানে এক প্রার্থনা সঙ্গীতের আয়োজন বুঝি। আশ্রয় পাব। খাদ্য পাব। দেশে ফিরে যাব। আনন্দে মন ভরে গেল।
খুব আশা ও উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালুম। বেলাভূমির ওপর দিকে ঘন বনের ভেতর থেকে সেই চাপা গম্ভীর অর্কেস্ট্রাধ্বনি ভেসে আসছে। কিন্তু যেই কয়েক পা এগিয়ে গেছি, কেউ খ্যানখেনে গলায় চেঁচিয়ে বলল, স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে-স্টপ ইট!
১০. অলীক আর্তনাদ
স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে-স্টপ ইট!
একবার নয়, বারবার কেউ ভূতুড়ে গলায় ধমক দিতে থাকল। সেই কণ্ঠস্বর যে মানুষের নয়, আমি হলফ করে বলতে পারতুম। থমকে দাঁড়িয়ে গেছি এবং ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে-স্টপ ইট-ঝাঁকুনি খেতে খেতে শব্দগুলো ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। চারদিকে প্রতিধ্বনির মতো। তারপর তাদের তীব্রতা ক্ষয়ে যাচ্ছে। হেঁপা রোগীর মতো শ্বাস-প্রশ্বাস জড়ানো গলায় মাথাকুটে নিষেধ করার ভঙ্গিতে কেউ কাউকে কিছু করতে বারণ করছে। তারপর শব্দগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসে মিশে যেতে থাকল। স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে-স্টপ ইট! তারপর যেন বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে গেল।
সেই চাপা গম্ভীর অর্কেস্ট্রার বাজনার দিকে কান গেল এবার। বাজনাটাও ততক্ষণে ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মনে হল, যেন আমার মাথার ভেতরই সেই আশ্চর্য সুন্দর সঙ্গীত শুনছি…অসংখ্য ঝিল্লির ডাকের মতো, অতি মৃদু, শ্রুতিপারের সেই ধ্বনি।
তারপর তাও একইভাবে মিলিয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য আমার মনে কী এক অনুভূতি ঝিলিক দিল। এ আমি কোথায় এসে পড়েছি তাহলে? আমার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে সকাল-বেলার শান্ত নরম রোদে সবুজ বনভূমি ঝলমল করছে। উঁচু ও নিচু, ছোট এবং বড়, স্থূল এবং শীর্ণ নানা আকৃতির উদ্ভিদ। তাদের অনেকেই থরে থরে ফুলে ফুলে সাজানো। মাটির ঘাসে ফলের গয়না পরে পরীদের মতো পা ছড়িয়ে বসে আছে কেউ কেউ। সুগন্ধে বাতাস মউমউ করছে। চারদিকে এখন যেন শব্দহীন হাসি, যেদিকে তাকাই সেদিকেই বালক-বালিকারা খুশিখুশি মুখে এক বিদেশি অতিথিকে বরণ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে বলে ভুল হয়। কোথাও দেখি সারবদ্ধ ঋজু বৃক্ষ প্রাজ্ঞ মানুষের গাম্ভীর্য নিয়ে আমাকে নিরীক্ষণ করছে। কোনও-কোনও বৃক্ষ যেন ভ্রু কুঞ্চিত করেছে—সন্দেহকুটিল সংশয়ান্বিত ভঙ্গি। ফলভারে নুয়ে পড়া এক বৃক্ষ বুঝি জননীর স্নেহে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তরুণ বৃক্ষেরা তাদের বলিষ্ঠ পেশল বাহু বাড়িয়ে হয়তো আমাকে আলিঙ্গন করতে চাইছে। এ আমি কোথায় এলুম? প্রতিটি ঝোপঝাড়, গাছ, ঘাসের শব্দহীন ভাষা যেন আমার বোধের ভেতর স্পষ্ট হয়ে উঠছে। লক্ষ লক্ষ কথা নিঃশব্দে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমার মস্তিষ্কে—মস্তিষ্ক থেকে মনে সেই সব দুজ্ঞেয় কথা স্পন্দনের হ্রস্ব-দীর্ঘ তরঙ্গিত রেখায় বিচিত্র কোডের মতো জমে উঠছে আমার মস্তিষ্ককোষে। এ বুঝি এক অদৃশ্য বেতার তরঙ্গ। কিন্তু ডি-কোডিং পদ্ধতি আমার জানা নেই বলে অর্থ নিষ্কাশন করতে পারছি না। অসহায় ব্যর্থ বিষণ্ণ এক মানুষ ঘটনাচক্রে এসে পড়েছি এক বিরাট মৌন চেতনার দরজায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি আর তাকিয়ে আছি।
হঠাৎ আমার তন্ময়তা কেটে গেল। স্বপ্নবৎ আচ্ছন্নতা ঘুচে গেল। মুহূর্তের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠল একটা জ্ঞান—যা এতক্ষণ আমার নাগালেই ছিল, অথচ গ্রাহ্য করিনি। আর সেই জ্ঞান আমাকে কিছুক্ষণের জন্য উত্তেজনায় আনন্দে বদ্ধ উন্মাদে পরিণত করে ফেলল। আমি বিজ্ঞানী