অন্ধকারে এবার আমার দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়েছে। বাঁদিকে পাহাড় ভাঙা চাঙড়ের ওপর দিয়ে উঠে যেতে অসুবিধা হল না। পাহাড়টা শদুয়েক ফুটের বেশি উঁচু নয়। এখানে পেছন দিকটা চমৎকার গড়ানে আবার হ্রদের দিকে পৌঁছে প্রিয়বর্ধন একটা প্ল্যান বাতলে দিল।
প্ল্যানটা মারাত্মক। কিন্তু প্রিয়বর্ধনের বুদ্ধিসুদ্ধির ওপর এখন আমার প্রচুর আস্থা জন্মে গেছে। স্পটলাইটটা তেমনি জ্বলছে। আমি চুপিচুপি তখনকার মতো ওটার কাছে এগিয়ে গেলুম। প্রিয়বর্ধন গেল বাঁদিকে হ্রদের কিনারা দিয়ে ঘুরে।
যে পাথরে আলোটা রাখা আছে, তার আড়ালে বসে রইলুম। ক্যারিববারা এখন চুপচাপ। তাদের নাক ডাকা শুরু হতে আরও ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হল। তারপর হাত বাড়িয়ে আলোর সুইচ অফ করে দিলুম এবং স্পটলাইটটা বাগিয়ে ফেললুম।
তারপর গুঁড়ি মেরে অন্য পাশে গিয়ে প্রিয়বর্ধনের শিসের অপেক্ষা করতে হল। একটু পরেই সেই শিস কানে এল। পাল্টা শিস দিলুম। তখন প্রিয়বর্ধন এসে হাজির হল। ফিসফিস করে বলল, মদের নেশায় কাহিল ব্যাটারা। আগে এই মালপত্রগুলো ধরো। তারপর অন্য কথা।
জিগ্যেস করলুম, চাবি হাতাতে পেরেছ তো?
হুঁউ। অনেক কিছুই। আমরা এখন রাজা হতে চলেছি!…
তখন রাত এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। আমাদের মোটরহোট ছুটেছে অকূল সমুদ্রে। প্রিয়বর্ধন যা সব হাতিয়ে এনেছে, তা হল : একটা স্টেনগান, একটা কিটব্যাগ, কিটব্যাগের ভেতর শতিনেক প্যাকেট করা কার্তুজ আর সেই চুরি যাওয়া দেবীমূর্তি। হ্যাঁ, আরও একটা জিনিস হাতিয়ে এনেছে প্রিয়বর্ধন। একটা খাদ্যদ্রব্যের প্রকাণ্ড প্যাকেট। তার ভেতর জ্যাম, জেলি, সসেজ, ফ্রায়েড ফিশের টুকরো, পাঁউরুটি পর্যন্ত। প্রিয়বর্ধন তবু পস্তাচ্ছিল। কেন যে ছাই ওদের কফির ফ্লাস্কুটা নিয়ে এলুম না। আহা, সমুদ্রের বুকে কফি খাওয়ার চেয়ে আনন্দ আর কিছুতে নেই!
এক সময় জিগ্যেস করলুম, কিন্তু এভাবে আমরা যাচ্ছি কোথায়? একসময় জ্বালানি ফুরিয়ে যাবে, তখন মোটরবোট অচল হয়ে যাবে না?
প্রিয়বর্ধনের আনন্দের ঘোরটা এককথায় যেন কেটে গেল। ঝুঁকে পড়ে মোটরবোটের কম্পাস দেখে নিয়ে বলল, সর্বনাশ! উত্তরে যেতে গিয়ে যে দক্ষিণে চলেছি। জ্বালানি যা আছে, আর অন্তত ঘন্টা তিনেক চলবে।
সে মোটরবোটের মুখ ঘুরিয়ে দিল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, সমুদ্রের এই এলাকায় তীব্র স্রোত আর ঢেউগুলোও রুখে দাঁড়াচ্ছে। যতবার মোড় নেওয়ার চেষ্টা করে মোটরবোট উল্টে যাওয়ার তালে থাকে। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে প্রিয়বর্ধন বলল, যেখানে খুশি যাক্। আর কিছু করার নেই।
আসন্ন বিপদের মুখে আমার বুদ্ধি খুলে গেল। স্পটলাইটটা জ্বেলে দিয়ে বললুম, প্রিয়বর্ধন, তুমি বলছিলে মূর্তিটার ভেতর কিওটা দ্বীপে যাওয়ার নক্সা আছে। একবার সেটা দেখলে হত না? যদি জ্বালানি থাকতে-থাকতেই আমরা সেখানে পৌঁছে যেতে পারতুম।
প্রিয়বর্ধন মুখ বেজার করে বলল, দেখতে পারো। তবে ক্যারিবোর মতো ঘুঘু যখন হুদিশ করতে পারেনি, তুমি পারবে বলে মনে হয় না।
মূর্তিটা সত্যি অপরূপ। অবিকল আমাদের দেবী সরস্বতীর মতো। হাতে বীণাও রয়েছে। মূর্তিটা পরীক্ষা করে উলটে পালটে দেখেও বুঝতে পারছিলুম না, ওর ভেতরে কিছু থাকতে পারে কি না। সাবধানে মোচড় দিয়ে দেখলুমও প্যাঁচ থাকলে যদি খোলা যায়। কিন্তু মূর্তিটা নিরেট।
হঠাৎ চোখ পড়ল ওটার মাথার পেছনে। একটা পেরেকের মতো। ওটাতে যেই চাপ দিয়েছি, তলার দিকের একটা জায়গা ঢাকনার মতো খুলে গেল। আর ঠকাস করে কী একটা পড়ল নিচের পাটাতনে। কুড়িয়ে দেখি, একটা কাত্তি!
অবিকল একই কাত্তি—যেমনটি রাজাকোর টুপির ভেতর পেয়েছিলুম। একই নকশা। প্রিয়বর্ধন বাঁ হাত বাড়িয়ে কাত্তিটা নিয়ে উলটেপালটে দেখে ফেরত দিল। বুঝলুম, কাত্তি জিনিসটা কী ও জানে না।
কাত্তিটাকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে আবিষ্কার করলুম, নকশাগুলো একদিকে নেমে গিয়ে যেন হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে বেখাপচাভাবে। মাঝখানে একটা তেমনি গাছ আছে, কিন্তু শেকড়গুলো কিনারায় হঠাৎ শেষ হওয়ায় মনে হল, জায়গার অভাবে পুরোটা আঁকা হয়নি, নাকি এটা আঁকিয়ের খেয়াল? ইংরেজি এ বি সি ডি ই এফের পর জিয়ের আধখানা কাটা।
তাহলে কি এটা অন্য একটা কাত্তির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার জন্য? অর্থাৎ রাজাকোর টুপির ভেতর পাওয়া কাত্তিটা না পেলে এটার রহস্য উদ্ধার করা যাবে না?
উলটো পিঠটা দেখামাত্র আমার সংশয় ঘুচে গেল। উলটো পিঠে গাছটা নেই শেকড়গুলো আছে। এ বি সি ডি ই এফ নেই, জি এইচ আই জে কে এল আছে। রাজাকোর কাত্তির উলটো পিঠটা ভাল করে লক্ষ্য করিনি। এর মানে দাঁড়াল : দুটো কাত্তি পরপর মিলিয়ে রাখলে দুপিঠে দুটো শেকড়ওলা গাছ দেখা যাবে এবং বারোটা রোমান হরফ দেখা যাবে চক্রকারে সাজানো।
প্রিয়বর্ধনকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলে সে আরও হতাশ হয়ে পড়ল!…
ভোর চারটেয় আমাদের মোটবোটের জ্বালানি ফুরিয়ে গেল। বৈঠা টানা নিরর্থক। তীব্র সমুদ্রস্রোত আর পেছনের ঢেউয়ের ধাক্কায় বোট গতিহারা হতে পারছে না।
দেখতে দেখতে দিনের আলো ফুটে উঠেছিল। সেই ধূসর আলোয় আমাদের এতক্ষণে চোখে পড়ল সামনে দীর্ঘ একটা কালো রেখা যেন। প্রিয়বর্ধন চেঁচিয়ে উঠল আনন্দে, মাটি! মাটি! আমরা মাটির দিকে চলেছি!
সমুদ্রের চারদিকে চাপচাপ লাল রং। প্রথম সূর্যের আভা ঝলমলিয়ে উঠেছে। প্রিয়বর্ধন মোটরববাটের সামনের ড্রয়ার খুঁজে একটা বাইনোকুলার পেয়ে গেল। দূরবীক্ষণ যন্ত্রটাতে চোখ রেখে সেই কালো রেখাটা দেখার পর সে গম্ভীর মুখে বলল, আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের মৃত্যু হবে জয়ন্ত! ঈশ্বরের নাম জপ করো! ওই মাটি কবরের মাটি।