চমক খেয়ে উঠে বসে বললম, কী হয়েছে?
ঝটপট আগুনটা নিভিয়ে ফেলো। এদিকে একটা আলো এগিয়ে আসছে।
প্রিয়বর্ধনের গলার স্বর কঁপছিল। আমি আগুনের কুণ্ডে একরাশ কঁচা পাতা চাপিয়ে দিয়ে দরজায় উঁকি দিলুম। নিচে হ্রদের ধারে সত্যি একটা আলো। তবে আলোটা এগিয়ে আসছে না। থেমে আছে।
০৯. স্টপ ইট! স্টপ ইট!
একটু পরেই বুঝতে পারলুম ওটা এক স্পটলাইট। প্রিয়বর্ধনকে সেকথা বললে সে কিছুতেই বিশ্বাস করল না। ভয় পাওয়া গলায় বলল, ডাইনির দ্বীপে এমন আলো দেখা যায় শুনেছি। জয়ন্ত, চলো আমরা এ গুহা থেকে পালিয়ে পাহাড়ের পেছনে কোথাও লুকিয়ে পড়ি। ডাইনিটা ঠিকই আমাদের গন্ধ পেয়ে যাবে। শুনেছি, সে নাকি জলজ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে খায়।
সে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। আমার কোনও কথা আমল দিল না। বরং সে পালিয়ে নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার জন্য আমার হাত ধরে টানাটানি শুরু করল।
লোকটা এত কুসংস্কারের ডিপো, ভাবা যায় না! আলোটা যখন বৈদ্যুতিক, তখন আলোর মালিক অবশ্যই সভ্য জগতের মানুষ। শক্ৰমিত্র যেই হোক, মানুষ তো বটে। তাছাড়া এমনও হতে পারে, কোনও মোটরবোট অথবা জাহাজ এসে এই দ্বীপের কাছে ভিড়েছে। উদ্ধার পাওয়ার এমন সুযোগ ছাড়া নয়।
নিজেকে ওর হাত থেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে ঢালু পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে থাকলুম। প্রিয়বর্ধন পেছনে চাপা গলায় আমাকে যাচ্ছেতাই গালমন্দ দিতে লাগল। আতঙ্কে লোকটার মাথায় গণ্ডগোল হয়ে গেছে হয়তো।
অন্ধকারে চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ হতে পারত, কিন্তু স্পটলাইটটা চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। তাই বারবার হোঁচট খাচ্ছিলুম পাথরে। আছাড় খেতেও হল বারকতক। শেষে এমন আছাড় খেলুম যে গড়াতে গড়াতে একেবারে নিচের ঝোপঝাড়ে পড়ে পোশাক ছিঁড়ে ফর্দাফাই হল। কাটায় শরীরের
অনেক জায়গা ছেড়ে গেল। জ্বালা করছিল ভীষণ।
কিন্তু আমি মরিয়া। ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে দেখি, আলোটা যত কাছে ভেবেছিলুম, তত কাছে নয়। একটা পাথরের ওপর আলোটা রাখা আছে। কিন্তু জনমানুষ নেই। থমকে দাঁড়াতে হল। ওটা কি সত্যি স্পটলাইট?
হ্যাঁ, তাতে তো কোনও ভুল নেই। কারণ আলোর ছটা একটা দিকেই পড়েছে—যেদিক থেকে যাচ্ছি, সেদিকে। আমি এখন কিছুটা বাঁদিকে দাঁড়িয়ে আছি বলে আলোর নাগালে নেই। এবার সাড়া দেওয়া উচিত ভেবে যেই ঠোঁট ফাঁক করেছি, সেই মুহূর্তে হেঁড়ে গলায় কেউ গান গেয়ে উঠল।
তারপর গানটা দুকলি গাওয়া হয়েছে, কেউ তেমনি দুর্বোধ্য ভাষায় তেড়ে ধমক দিল। সঙ্গে সঙ্গে গানটা থেমে গেল। তারপর অনেকগুলো গলায় কারা হেসে উঠল।
তাহলে আলোটার ওপাশে পাথরের পেছনে একদঙ্গল মানুষ আছে। কারা তারা? একটু দোনামোনা হচ্ছিল আমার। ক্যারিবো কিংবা কিয়াংয়ের দলবল নয় তো? গিয়ে ওদের পাল্লায় পড়লে আমার ভাগ্য আবার অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।
প্রায় বুকে ভর করে, কখনও হামাগুড়ি দিয়ে পাথরটার পেছনে গেলুম। তারপর কান পেতে রইলুম। ওরা চাপা গলায় কথা বলছে। একবর্ণও বুঝতে পারছি না। পাথরের ফাঁক দিয়ে ওদের আবছা মূর্তিগুলো চোখে পড়ল। ওরা ছায়ায় হাত পা ছড়িয়ে কেউ বসে বা শুয়ে আছে। কী করা উচিত ভাবছি, আর দরদর করে ঘামছি উত্তেজনায়।
হঠাৎ পেছনে অস্পষ্ট একটা শব্দ শুনে চমকে উঠলুম। ঝটপট ঘুরে বসতেই প্রিয়বর্ধন ফিসফিস করে বলল, চুপ!
লোকটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। ভেবেছিলুম ডাইনির ভয়ে লেজ তুলে পালিয়ে গেছে। গুহা থেকে। অথচ সে দিব্যি আমার পেছন পেছন চুপিচুপি এসে হাজির। ঘাপটি মেরে বসে কিছুক্ষণ কান পেতে কথাবার্তা শোনার পর আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, শয়তান ক্যারিবো!
তাহলে ঠিকই অনুমান করেছিলুম। ভাগ্যিস, হুড়মুড় করে ওদের সামনে গিয়ে হাজির হইনি। আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা শোনার পর প্রিয়বর্ধন আমাকে অনেকটা দূরে নিয়ে গেল। হ্রদের ধারে হাঁটতে হাঁটতে চাপা গলায় বলল, শাপে বর হয়েছে, জয়ন্ত! ক্যারিববা মোটরবোট নিয়ে এখানে হাজির হয়েছে। ঠিক বুঝতে পারলুম না কী একটা গণ্ডগোল ঘটেছে। যতদূর মনে হল, ওরা কিওটা দ্বীপের হদিশ করতে পারছে না। তাই হতাশ হয়ে ঢকঢক করে মদ গিলে মাতাল হচ্ছে।
বললুম, কিন্তু আমরা কোথায় যাচ্ছি?
প্রিয়বর্ধন বলল, স্টেনগানটা থাকলে ক্যারিবো আর তার তিনজন সঙ্গীকে ওখানেই যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিতুম। তারপর দেবী মূর্তিটা উদ্ধার করে ওর মোটরবোট নিয়ে কিওটা অভিযানে পাড়ি জমাতুম! যাক্ গে, চুপচাপ এস। কী করি দেখো না।
হ্রদ্র ঘুরে পুবদিকে গিয়ে ক্যারিবো তার দলবলকে এড়িয়ে প্রিয়বর্ধন আমাকে সমুদ্রের ধারে নিয়ে গেল। তখনও টের পাইনি ওর উদ্দেশ্য। একটু পরে সেটা জানলুম।
এদিকটায় সমুদ্রের খাড়ি। খাড়ির এককোণে মোটরববাটটা আবিষ্কার করতে দেরি হল না। মোটরববাটে কেউ পাহারা দিচ্ছে না। প্রিয়বর্ধন বলল, স্টার্ট দেওয়ার উপায় নেই। ক্যারিবোর পকেটে চাবি। কাজেই এসো, এটাকে আমরা কোথাও লুকিয়ে রেখে আসি। ওটার মধ্যে বৈঠা আছে। অসুবিধে হবে না। শিগগির!
খাড়ির জলটা অপেক্ষাকৃত শান্ত। দক্ষিণ ঘুরে আমরা মোটরবোটটা সেই গুহাওয়ালা পাহাড়ের পেছন দিকে নিয়ে গেলুম। তারপর সংকীর্ণ আরেকটা খাড়ির ভেতর পাহাড়ের তলার দিকে চওড়া ফাটলের ভেতর লুকিয়ে রাখলুম। প্রিয়বর্ধন মোটরবোটের অন্ধিসন্ধি খুঁজে নিরাশ হয়ে বলল, ব্যাটারা বৈঠাগুলো বাদে কিচ্ছু রেখে যায়নি। না অস্ত্রশস্ত্র না খাবার-দাবার! মহাধড়িবাজ লোক ওই ক্যারিবো।