দিগন্তে মাঝে মাঝে কালো রেখা ভেসে উঠেছিল। নিশ্চয় আর একটা দ্বীপ। কিন্তু দূরের দিকে কোনো জাহাজ বা নৌকো চোখে পড়ছিল না। প্রিয়বর্ধন ঠোঁট কামড়ে ধরে সমুদ্র দেখছিল। কিছুক্ষণ পরে ফেঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল, শয়তান ক্যারিববাকে যদি এখন পেতুম! ওর মুণ্ডুটা কচকচ করে খেয়ে খিদে মেটাতুম!
ক্যারিববা তোমাকে ফেলে পালিয়ে গেল কেন প্রিয়বর্ধন?
আমার প্রশ্ন শুনে প্রিয়বর্ধন চুপচাপ পাথরে লাঠিটা দিয়ে আঁচড় কাটবার ব্যর্থ চেষ্টা করল। তারপর বলল, কিয়াংকে ও ভীষণ ভয় পায়। কিয়াং কোটিপতি লোক। ওর দলবল বিরাট। ক্যারিববা তো এক সময় কিয়াংয়েরই ডান হাত ছিল।
দুজনের বিবাদের কারণ কী?
রোমিলার বাবা রাজাকোর ঘর থেকে যে দেবীমূর্তিটা চুরি করে এনে ক্যারিববাকে দিয়েছি, বিবাদ ওইটে নিয়ে। জিনিসটার আসল মালিক হল কিয়াং। ক্যারিববা ওটা কিয়াংয়ের বাড়ি থেকে চুরি করে রাজাকোকে বেচেছিল। কিয়াং ক্যারিবোকেই সন্দেহ করেছিল। তাই তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছিল। ক্যারিববা রাজাকোর সেই টাকায় স্কুনার কিনেছিল। তারপর যেভাবেই হোক, সে জানতে পেরেছিল, মূর্তিটার ভেতর কিওটা দ্বীপের সন্ধান লেখা আছে।
চমকে উঠলুম। কিওটা দ্বীপের? মানে—যে দ্বীপে গাছপালা কথা বলে?
প্রিয়বর্ধন হাসল। আমার ভুল শুধরে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, উঁহু—গান গায়।
বেশ। তারপর?
তারপর আর কী? ক্যারিবো আমাকে টাকার লোভ দেখাল। তাছাড়া প্রতিজ্ঞা করে বলল, আমাকে ও কিওটা দ্বীপে নিয়ে যাবে। আমি শয়তানটার কথায় পড়ে রোমিলার মতো ভাল মেয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেললুম। ওঃ! নরকে আমার জায়গা হবে না জয়ন্ত!
অনুতাপে সে চুল আঁকড়ে ধরল। বললুম, যাক গে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আর বলে লাভ নেই। কিন্তু কাল সন্ধ্যায় কিয়াংয়ের দলই কি ক্যারিবোর স্কুনারে হামলা করেছিল? কেন?
কিয়াং নিশ্চয় টের পেয়েছে, মূর্তিটা এতদিন রাজাকোর কাছে ছিল এবং আবার সেটা ক্যারিববার কাছে ফিরে এসেছে। কিয়াংয়ের চারদিকে চর।
তাহলে কি রাজাকোকে খুন করেছে কিয়াংয়েরই লোক?
তা আর বলতে?
এসব কথা শুনে মনমরা হয়ে বললুম, তাহলে এতক্ষণে ক্যারিবো কিওটা দ্বীপের দিকে রওনা হয়েছে। হয়তো পৌঁছেও গেছে।
প্রিয়বর্ধন জোরে মাথা নেড়ে বলল, অত সহজ নয়। মোটরবোট নিয়ে কিওটা যাবে! আমার মনিব রাজাকো একদিন নেশার ঘোরে আমাকে বলেছিলেন, কিওটা নামে একটা দ্বীপ আছে—তার চারদিকে পাহারা দেয় জলের ডাইনিরা। কাজেই বুঝতে পারছ, এতক্ষণে ক্যারিববার মাংস ডাইনিরা ছিঁড়ে খাচ্ছে।
কিন্তু প্রিয়বর্ধন, গান করে এমন সব গাছ দেখাতেই বা এত আগ্রহ কেন ক্যারিববার? কেন সেখানে কিয়াংই বা যেতে চায়?
প্রিয়বর্ধন চাপা গলায় বলল, ওই দ্বীপে নাকি প্রাচীন যুগের জলদস্যুদের বিস্তর ধনরত্ন লুকানো আছে।
হেসে ফেললুম।সেই চিরকেলে গল্প! গুপ্তধন আর গুপ্তধন! প্রিয়বর্ধন, গুপ্তধনের গল্প কখনও সত্য হয় না।
প্রিয়বর্ধন আমার পরিহাসে কান করল না। বলল, তুমি জানো না জয়ন্ত, কোকেস আইল্যান্ড কেন, সারা তল্লাটে যেখানে যাবে, তুমি কিওটা দ্বীপের অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প শুনতে পাবে। সেখানকার গাছপালা গান গেয়ে সেই গুপ্তধনের খোঁজ দেয়। গানের সুরে বলে, আয়, তোকে রাজা করে দিই!
প্রিয়বর্ধন কিওটা দ্বীপের বিচিত্র সব গল্প বলতে থাকল।
আমি ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছিলুম। এতদিন কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে কত অ্যাডভেঞ্চারে গিয়ে কত না বিপদে পড়েছি। কিন্তু চরম মুহূর্তে উনি ত্রাণকর্তার মতো আমার উদ্ধারে হঠাৎ যেন মাটি খুঁড়ে হাজির হয়ে সহাস্যে সম্ভাষণ করেছেন, হ্যাল্লো ডার্লিং! এই দ্বীপে নির্বাসিত হয়েও তার আশা করতে দোষ কী?…
কিন্তু দিনটাই বৃথা কেটে গেল। উদ্ধার হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখলুম না। দুপুরে দুজনে হ্রদের জলে স্নান করলুম। আবার সেই পোড়ামাছের লাঞ্চ। আবার জাহাজের আশায় সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসে থাকা। তারপর দিন ফুরিয়ে আসছে দেখে রাতের আশ্রয়ের কথা ভাবতে হল দুজনকে। কাল সকালে বরং ভেলায় ভেসে পাড়ি জমানোর কথা ভাবা যাবে।
এই দ্বীপটা খুবই ছোট। উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে সেটা বুঝতে পেরেছিলুম। হ্রদের অন্যদিকটায় জঙ্গলের ভেতর কালো পাথরের কয়েকটা পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। ওখানে আমরা আরামে রাত কাটানোর মতো একটা গুহা আবিষ্কার করে ফেললাম।
সারাদিন কোনও জনমানুষ দেখিনি। প্রাণী বলতে কয়েকটা গিরগিটি দেখেছি আর এক দঙ্গল শকুন! তারা কী খেয়ে বেঁচে থাকে কে জানে! গুহার ভেতর ঢুকে আগুন জ্বালিয়ে ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচা গেল। এখানকার শুকনো কাঠগুলোর আশ্চর্য গুণ। একটু ঘষলেই ধোঁয়া উড়তে থাকে। সহজে আগুন ধরে যায়।
গুহার ভেতরটা বেশ মসৃণ। দরজাটা বড়। দরজার কাছে বসে প্রিয়বর্ধন লাঠি হাতে পাহারা দিচ্ছিল। একরাশ কাঁচা পাতা আর ঘাস ছিঁড়ে এনে বিছানা করেছে। ক্লান্তিতে ঘুম এসে গিয়েছিল। আমার ঘড়িটা ভাগ্যিস অক্ষত আছে। প্রিয়বর্ধনের ঘড়িটাও অটুট, দিব্যি সময় দিচ্ছে। পালাক্রমে দুজনে ঘুমোব এবং পাহারা দেব।
সবে চোখ বুজেছি। বাইরে অন্ধকার ঘন হয়েছে। গুহার ভেতর আগুনটা ধিকিধিকি জ্বলছে এবং প্রিয়বর্ধন গুনগুন করে কী গান গাইছে অজানা ভাষায়। হঠাৎ তার গান থেমে গেল। চাপা গলায় সে বলে উঠল জয়ন্ত! জয়ন্ত! ঘুমলে নাকি?