বাধা দিয়ে বললুম, কিন্তু এখানে এলুম কী ভাবে?
যেভাবে আসা উচিত। প্রিয়বর্ধন আগুনে আরেকটা মাছ রেখে বলল। সারা রাত আমরা ভেলায় কাটিয়েছি। তুমি তো ভিরমি খেয়ে পড়ে ছিলে ভয়ের চোটে। অগত্যা তুমি যাতে ভেলা থেকে ছিটকে হাঙরের পেটে ঢুকে না যাও, আমি তোমার পেটের ওপর পা চাপিয়ে ঠেসে রেখেছিলুম।
নচ্ছার লোকটা আমার পেটের ওপর পা চাপিয়েছিল ক্যারিববার মতো, ভাবতেই গা জ্বালা করে। কিন্তু লোকটাকে যতটা খারাপ মনে করেছিলুম, ততটা খারাপ নয়। বললুম, তারপর এখানে কীভাবে এলুম?
প্রিয়বর্ধন বলল, ভোর নাগাদ ভেলামশাই নিজের ইচ্ছে মতো এনে ফেলল এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপে। আমি কি নিজের ইচ্ছেয় এসেছি? ওই যে বাঁধের মতো টিলা পাহাড় দেখছ, তার নিচে সমুদ্র। বাপস! কিনারা জুড়ে ড়ুবো পাথরে ভর্তি—ভেলাটার সঙ্গে ঠোক্কর লাগলে দুজনেই গুড়ো হয়ে যেতুম। বুঝলে মিস্টার? ভেলাটাকে পুজো করা উচিত। ওই দেখ, ওকে গাছে টাঙিয়ে রেখেছি।
গাছের গুঁড়ির মাথায় চুপসে যাওয়া প্রকাণ্ড টায়ারের মতো ভেলাটাকে দেখতে পেলুম। বললুম, আমি তাহলে সারারাত অজ্ঞান ছিলুম?
হুঁ, ছিলে। কাজেই তোমার ঠ্যাং দুটো ধরে টানতে টানতে বিচে নামাতে হল। তারপর একবার ভাবলুম, তোমাকে বিচেই ফেলে রাখি। কিন্তু এই জঘন্য দ্বীপে যা শকুনের উপদ্রব! তোমাকে একা ফেলে যে ক্ষিদে মেটাতে আসব, উপায় নেই। তবে তার চেয়ে বড় কথা, আমি নারকোল গাছে চড়তে পারিনে। সমুদ্রের বাচ্চা তো! তাই ভাবলাম, তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। তুমি নিশ্চয় নারকোল গাছে চড়তে পারো?
মোটেও পারি না।
প্রিয়বর্ধন লাফিয়ে উঠল। পারো না? তাহলে কেন তোমাকে কাঁধে করে এই নিরাপদ জায়গায় নিয়ে এলুম?
বুঝতে পারছিলুম, লোকটি খুব আমুদে প্রকৃতির। সে আমাকে বয়ে এনে এখানে শুইয়ে রেখেছে। তারপর হ্রদের জলে পাথর ছুড়ে একগাদা মাছ মেরে এনেছে। কিন্তু আগুন কোথায় পেল? জিগ্যেস করলে তার বুদ্ধির পরিচয়ও পেলুম। দুটো শুকনো কাঠে ঘষাঘষি করে শুকনো পাতা উলাই করে গুলতি বানিয়ে ফুঁ দিতেই আগুন জ্বলে উঠেছে। ব্যাপারটা ভারি সোজা। প্রথমে কাঠ দুটো জ্বলে উঠবে। তখন গুঁড়ো পাতার গুলতিটা ধরিয়ে নিলেই হল।
রোদে শুয়ে থাকার ফলে আমার ভিজে পোশাক যেমন শুকিয়ে গেছে তেমনি সারা রাতের সমুদ্র জলের হিমটাও গেছে ঘুচে। সূর্য মানুষের শরীরকে শক্তি জোগায়। আমি এখন সম্পূর্ণ ফিট হয়ে গেছি। একটুও দুর্বলতা টের পাচ্ছি না।
হ্রদটা ছোট। সমুদ্রের সঙ্গে তার যোগ নেই; বৃষ্টিজলের হ্রদ। তাই জলটা পান করা যায়। খুব স্বচ্ছ সেই জলে মাছের ঝাক দেখে তাক লেগে গেল।
জল খেয়ে সেই গাছের তলায় ফিরে প্রিয়বর্ধন বলল, একেই বলে বরাত। কাল সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত আমরা ছিলুম শত্রু। এখন হয়েছি বন্ধু। যাক্ গে, তোমার নামটা কী বলছিলে যেন কাল?
জয়ন্ত চৌধুরি।
জয়ন্ত, আমরা কোথায় এসে পড়েছি জানো? বলে সে ভয়ের চোখে চারদিক দেখে নিল। আমার খালি সন্দেহ হচ্ছে, এ যেন সেই ডাইনির দ্বীপ।
ডাইনির দ্বীপ মানে?
ছেলেবেলা থেকে নাবিকদের কাছে ডাইনির দ্বীপের ভয়ঙ্কর সব গল্প শুনেছি। থাগে, ওসব বলতে নেই। বললেই বিপদ হবে শুনেছি। আমাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্রও নেই। তোমার পকেটে একটা রিভলভার ছিল। সেটা কাছে রেখেছি। কিন্তু জলে ভিজে অকেজো হয়ে গেছে। গুলিগুলো পর্যন্ত বের করা গেল না।
আমার রিভলভার নিয়েছ কেন? ফেরত দাও।
মুচকি হেসে প্রিয়বর্ধন পকেট থেকে আমার অস্ত্রটা বের করে দিল। পরীক্ষা করে দেখলুম, সত্যি ওটা অকেজো হয়ে গেছে। প্রিয়বর্ধন বলল, আমার স্টেনগানটা কখন সমুদ্রে ছিটকে পড়েছে টের পাইনি। যাক দুটো লাঠি ভেঙে নিই গাছের ডাল থেকে। তারপর সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসব—যদি দৈবাৎ কোন জাহাজ চোখে পড়ে। নিদেনপক্ষে ভেলাটা তো রইলই। গায়ে জোর ফিরে পেলেই ভেসে পড়া যাবে।
সমুদ্রতীরে যাওয়ার সময় নারকোল বনের ভেতর অসংখ্য শুকনো নারকোল পড়ে থাকতে দেখলুম। কিন্তু প্রিয়বর্ধনের শুকনো নারকোল নাকি মুখে রোচে না। গাছের ডগায় ঝুলন্ত নরম নারকোল শাঁসের কথা বলতে তার জিভে জল এসে গেল। আমাকে গাছে চড়ানোর জন্য সাধাসাধি করেও যখন রাজি হলুম না, তখন তার মুখটা বেজার হয়ে উঠল। কিন্তু আমি জানি, এই দ্বীপ থেকে উদ্ধার না পেলে শুকনো নারকোলই খেতে হবে। কাহাতক মাছ পোড়া খেতে ভাল লাগবে ওর? আমি পাথরে আছাড় মেরে কয়েকটা নারকোল ভেঙে ফেললুম। তারপর টুকরো শাসগুলো জামা ও প্যান্টের পকেটে বোঝাই করলুম। ন্যাড়া পাথরের বাঁটে বসে যখন সেগুলো চিবোচ্ছি, তখন প্রিয়বর্ধন হাত বাড়িয়ে বলল, দেখি একটুখানি!
কিছু চিবিয়েই সে ফেলে দিল। তবে একথাও সত্যি এমন স্বাদ গন্ধহীন নারকোল জীবনে কখনও খাইনি। রুবিদ্বীপের নারকোল খেকো চিংড়িগুলোর কথা মনে পড়ছিল। আহা, সেই সুস্বাদু চিংড়ি সমুদ্র থেকে যদি ধরা যায়। লোভী চোখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলুম।
ড়ুবো পাথরে বহুদুর পর্যন্ত সমুদ্রের নীল জলে কালো কালো ছোপ পড়ে আছে। যেন অসংখ্য দানবের মাথা। কোনওটা হাতির মতো দেখাচ্ছে। পাথরগুলো ড়ুবে যাচ্ছে, আবার ভেসে উঠছে। সাদা ফেনার পুঞ্জ জমছে। জলের শব্দও প্রচণ্ড। ওই সব পাথরের ভেতর দিয়ে ঠোক্কর খেতে খেতে রবারের ভেলাটা ভদ্রলোকের মতো আমাদের তীরে পৌঁছে দিয়েছে। সত্যি, ভেলাবাবাজির পুজো দেওয়া উচিত।