কেবিনের কার্নিশে একটা রবারের নৌকো আটকানো আছে। ওটা টেনে বের করতে পারছি না।
তোর বন্ধুরা কোথায় গেল?
ওরা আমাকে ফেলে বোটে চেপে কেটে পড়েছে। ওরা আমার বন্ধু নয়, শত্রু! বলে সে কেঁদে ফেলল। উঃ! ক্যারিবো এমন করবে আমি ভাবতেও পারিনি!
ওর কান্না দেখে মনটা নরম হল। সমুদ্রের গ্রাস থেকে বাঁচতে হলে এখন ওর সহযোগিতাও দরকার। বললুম, তোমার স্টেনগানটা কোথায়, আগে দাও। তারপর কথা হবে।
বিশ্বাস করো, ওরা কেড়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু আর দেরি করা উচিত নয়, যদি প্রাণে বাঁচতে হয়। স্কুনারটা আর মিনিট কুড়ি-পঁচিশের মধ্যেই ড়ুবে যাবে হয়তো। চলো, আমরা রবারের নৌকোটা বের করি।
ওকে ছেড়ে সতর্কভাবে উঠে দাঁড়ালুম। এতক্ষণে মনে পড়ল আমার পকেটে রিভলভার আছে। জলে ভিজে গেলেও ওটার সাহায্যে পিওবেদেনেকে শায়েস্তা করতে অসুবিধে হবে না।
রিভলভারটা ওর বুকে ঠেকিয়ে বললাম, চলো! কোথায় নৌকো আছে দেখি।
পিওবের্দেনে কাকুতি-মিনতি করে বলল, বিশ্বাস করো! আমি ক্যারিববার মতো দুষ্টু লোক নই। ওর প্ররোচনায় পড়ে রোমিলার সঙ্গে নেমকহারামি করেছি। জানতুম না, নচ্ছার ঠগ আসলে মূর্তিটা হাতানোর জন্য আমার সঙ্গে ভাব জমাবে।
ঠিক আছে। চুলো, নৌকো কোথায় আছে দেখি।
স্কুনার একপাশে কাত হয়ে গেছে। বৃষ্টিটা ধরে এল। কিন্তু ঝোড়ো বাতাস থামল না। টলতে টলতে অনেক কষ্টে রবারের নৌকোটা টেনে বের করলুম দুজনে। তারপর পালাক্রমে ফুঁ দিয়ে ওটাকে ফোলাতে শুরু করলুম। ততক্ষণে স্কুনার আরও কাত হয়েছে। দুজনেরই দম ফুরিয়ে মারা পড়ার দাখিল। নৌকাটা আসলে গোল মোটরের টায়ারের মতো প্রকাণ্ড একটা চাকা এবং মধ্যিখানে আন্দাজ এক বর্গমিটার একটা রবারের বালিশ আটকানো। সেটাও দম দিয়ে ফোলানো হল। তারপর পিওবেদেনে বলল, তুমি আগে উঠে বোসো। আমি ঠেলে ভাসিয়ে দিয়ে তারপর উঠব।
স্কুনারের যেদিকটা কাত হয়ে সমুদ্রের ঢেউ ঢুকছে, সেদিকে ঠেলে দিল পিওবেদেনে। তারপর নিজে এক লাফে উঠে বসল। সে যেন নাগরদোলায় চড়া। স্কুনারের রেলিং হাত বাড়িয়ে ধরে সে রবারের এই অদ্ভুত ভেলাটাকে শেষ প্রান্তে নিয়ে গেল। লোকটার বুদ্ধি আছে বটে! শেষ দিকটায় নিয়ে গেলে ঢেউয়ের ঝাঁপটায় ভেলাসমেত আমরা আবার ডেকে গিয়ে পড়তুম।
সমুদ্র এবার আমাদের লুফে নিল। প্রতিমুহূর্তে আশঙ্কা হচ্ছিল তলিয়ে যাব, কিন্তু এই আশ্চর্য ভেলা দিব্যি ভেসে রইল ঢেউয়ের মাথায় একপার ওপরে একবার নিচে নাগরদোলার মতো।
ঢেউয়ের মাথায় পৌঁছুলে দিগন্তে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আলোর ঝক দেখতে পাচ্ছিলুম। আবার হারিয়ে যাচ্ছিল কালো জলের দেয়ালের পেছনে।
চেঁচিয়ে জিগ্যেস করলুম, পিওবেদেনে! ওটা কোন্ দ্বীপ?
জলের গর্জনের ভেতর পিওবেদেনে কী বলল, শুনতে পেলুম না। যদিও সে আমার মাত্র একহাত দূরে ফুলন্ত টায়ারের মতো ভেলার কিনারা আঁকড়ে বসে আছে।
মাথার ওপর এতক্ষণে নক্ষত্র ঝিকমিক করতে দেখা গেল। বাতাসটাও কমে এল ক্রমশ। কিছুক্ষণ আগে যে লোকটি ছিল আমার জঘন্য শত্ৰু, সে এখন বন্ধু হয়ে গেছে। কারণ প্রাণের দায় বড় দায়। রবারের ভেলায় দুজনেই ঠান্ডাহিম শরীরে ভেসে চললুম। কোথায় পৌঁছুব কে জানে!
০৮. ও কিসের আলো?
চোখ খুলে কয়েক সেকেন্ড কিছু বুঝতে পারলুম না। তারপর মনে হল, রুবি দ্বীপে আমাদের হোটেলেই শুয়ে আছি। কিন্তু এত আলো কেন? না—আলো নয়, রোদ ঝলমল করছে উজ্জ্বল রোদ। আমার পিঠের নিচে বালি। মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। আমি এখানে শুয়ে আছি কেন?
সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম কিছুক্ষণ। আমি কি স্বপ্ন দেখছি? নিশ্চয় একা টানা অদ্ভুত ধরনের স্বপ্নের মধ্যে কাটাচ্ছি। বাঁদিকে নারকেল বন আর ঘন আগাছার জঙ্গল। ডানদিকে উঁচু বাঁধের মতো ন্যাড়া টিলা। সামনে ছোট্ট একটা হ্রদ। তারপর পেছনে তাকিয়ে প্রিয়বর্ধনকে দেখামাত্র আগাগোড়া সবটাই মনে পড়ে গেল।
প্রিয়বর্ধন একটা গাছের তলায় আগুন জ্বেলে কী একটা করছিল আমাকে উঠতে দেখে সে মুখ ফেরাল। তার মুখে কেমন একটা মিষ্টি-মিষ্টি হাসি। হ্যালো মিস্টার! শরীর ঠিক তো?
জবাব দিলাম না। এই লোকটা আমার জঘন্য শত্রু। সে ক্যারিবোর স্কুনারে আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। অথচ তারই সঙ্গে একই বেলায় অথৈ সমুদ্রে আমাকে ভাসতে হয়েছিল। ভাগ্যের তামাশা আর কাকে বলে? আমি অবাক হয়ে তাকে দেখছিলুম। ভাবছিলুম, ইচ্ছে করলেই সে আমাকে সমুদ্রে ফেলে দিতে পারত। কেন তা করেনি?
প্রিয়বর্ধন আমার হাবভাব দেখে হয়তো অবাক হল। বলল, কী হল? চলে এস এখানে। তোমার জন্য কিছু ব্রেকফাস্টের আয়োজন করেছি।
বলে সে হাসতে হাসতে একটা পোড়া মাছ দেখাল। সঙ্গে সঙ্গে আমার খিদে চনমন করে উঠল। তার সম্পর্কে রাগ আর শত্রুতার ভাবটাও কেটে গেল। তার কাছে গিয়ে বসে পড়লুম। সে একরাশ কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বেলেছে। আগুনের কুণ্ডের পাশে কয়েকটা পোড়া আর কয়েকটা তাজা মাছ। মাছগুলো দেখতে বাচ্চা ইলিশের মতো। আমার হাতে একটা পোড়া মাছ গুঁজে দিয়ে প্রিয়বর্ধন নিজেও একটা চিবুতে শুরু করল। চিবোতে চিবোতে বলল, তুমি অবাক হচ্ছ না মিস্টার?
বললুম, নিশ্চয় হচ্ছি। কারণ এতক্ষণে আমাদের হাঙরের পেটে থাকার কথা।
প্রিয়বর্ধন আরও জোরে হেসে বলল, বরাত জোরে এ যাত্রা জোর বেঁচে গেছি। আসলে কী জানো? ওই রবারের ভেলাগুলো খুব মজবুত এবং বিশেষ ধরনে তৈরি। যত ঢেউ থাক, কিছুতেই ওল্টাবে না। তাছাড়া আমি হলুম সমুদ্রের বাচ্চা। আজীবন সমুদ্রের মানুষ হয়েছি।