মিঃ কিয়াং তা হাতিয়ে নিয়েছেন রাজাকোকে খুন করে।
এই কথাটা বলার সময় আমি আদৌ জানতুম না এরা কিয়াং নামে সেই ধনী মৎস্যব্যবসায়ী ও রাজাকোর প্রতিদ্বন্দ্বীর অনুচর কি না। আন্দাজে ঢিলটা লেগে গেল। ক্যারিববা লাফিয়ে উঠে দাঁত কিনমিড় করে বলল, কিয়াং হাতিয়েছে তাহলে? সর্বনাশ!
পিওবের্দেনে মুখ চুন করে বলল, দেখলে তো ক্যারিববা? আমি তোমাকে বলেছিলুম রাজাকোকে খুন করেছে কিয়াংসায়েবের লোক। তুমি বিশ্বাস করোনি! তাছাড়া এও বলেছিলুম, রাজাকোর কাছে একটা কাত্তি আছে আমি জানি।
বললুম, হ্যাঁ, টুপির মধ্যে লুকোনো ছিল শুনেছি।
ক্যরিবো কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ দুমদুম শব্দে কাঠের সিঁড়ি কাঁপিয়ে একটা বেঁটে লোক এসে দরজায় উঁকি মেরে বলল, গতিক সুবিধের নয় কর্তা! হাঙরের ঝাক এসে পড়েছে।
ওরা ব্যস্ত হয়ে উঠল। ক্যারিববা বলল, পিওবের্দেনে, ওর কাছে থাকো! ৭০৩ নম্বরের দিকে রওনা দিচ্ছি।
সবাই ওপরের ডেকে চলে গেল। পিওবেদেনে দরজা বন্ধ করে পোর্টহোলে চোখ রেখে কিছু দেখতে লাগল। তারপর নোঙর তোলার ঘড় ঘড় শব্দ শুনতে পেলুম। তারপর স্কুনার দুলতে শুরু করল। যান্ত্রিক গর্জন কানে এল। বুঝলুম স্টার্ট দিয়েছে। আবছা জলের শব্দ, স্কুনারের প্রচণ্ড দুলুনি আর গর্জন মিলে একটা আলোড়ন শুরু হয়ে গেল।
কেবিনের ভেতর ততক্ষণে আলো কমে গেছে। একটু পরে আলো জ্বলে উঠল। পিওবের্দেনে পোর্টহোল থেকে হঠাৎ ছিটকে সরে এল। তারপর দুমদাম্ ফট্ ফট্টা এরকম অদ্ভুত সব শব্দ হতে থাকল। বললুম, ব্যাপার কী মিঃ পিওবেদেনে?
সে দাঁত মুখ খিচিয়ে বলল, চুপ ব্যাটা কলকাত্তাই ভূত!
গ্রাহ্য না করে বললুম, কারও সঙ্গে লড়াই বাধল বুঝি? পিওবেদেনে আমার কথার জবাব না দিয়ে কোনার দিকে কাঠের দেয়ালের একটা হুকে হ্যাঁচকা টান মারল। দেখি, ওটা একটা প্রকাণ্ড দেরাজ। দেরাজ থেকে সে যা বের করল, তা একটা স্টেনগান আর একটা কার্তুজের বেল্ট। সে পোর্টহোলের কাচটা সরিয়ে স্টেনগানের নল ঢুকিয়ে দিল। তারপর গুলি ছুড়তে শুরু করল।
বুঝলুম কাদের সঙ্গে জোর লড়াই বেধেছে। ছোট্ট জাহাজটা বেজায় দুলছে। মাঝে মাঝে ভীষণভাবে কাত হয়ে যাচ্ছে। আর আমি কাঠের মেঝেয় অসহায়ভাবে একবার এদিক একবার ওদিকে গড়িয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু তাতে একটা লাভ হল। বাঁধনগুলো অনেকটা ঢিলে হয়ে গেল। একটু পরে পোর্টহোলের কাচটা ঝনঝন শব্দে ভেঙে গেল। পিওবের্দেনে মুখ বিকৃত করে লাফ দিয়ে সরে এল। তারপর সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিল। কেবিনে ঘরঘুট্টি অন্ধকার এবার। সেই সুযোগে বাঁধন খুলতে থাকলুম। পিওবের্দেনে পোর্টহোলের কাছে আছে তা বুঝতে পারছি। ভোলা পোর্টহোল গুলিগোলার আওয়াজ ক্রমশ কমে আসছে। কিন্তু সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাচ্ছি। এদিকে কেবিনে জল ঢুকে মেঝে জলময় হয়ে যাচ্ছে। বাঁধন খুলে সাবধানে উঠে বসলুম যখন, তখন কেবিনের ভেতর কয়েক ইঞ্চি জল। যখনই স্কুনার কাত হচ্ছে, তখনই বেশি করে জল ঢুকছে। আমার ভয় হল, এই লোনা জলে শেষ পর্যন্ত ড়ুবে মরব না তো?
তার আগেই একটা কিছু করা দরকার। পিওবেদেনের চেহারা আবছা দেখা যাচ্ছিল। সে পোর্টহোলে কী একটা চাপা দেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত। তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছি, সেইসময় দরজায় ধাক্কা পড়ল। জলের শব্দের মধ্যে কে চেঁচিয়ে ডেকে বলল, পিওবের্দেনে! বেরিয়ে এস! স্কুনারে জল ঢুকছে।
পিওবেদনে ঝটপট দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। ভাগ্যিস আলো জ্বালাল না। বিপদের মুখে তার এটাই স্বাভাবিক। খোলা দরজা দিয়ে এবার জলের প্রবল ছাঁট এসে ঢুকতে লাগল। মেঝেয় এখন প্রায় হাঁটু জল জমে উঠেছে। বুঝতে পারলুম স্কুনার ড়ুবতে চলেছে। প্রতিপক্ষের গুলিগোলায় নিশ্চয় ঝাঁঝরা হয়ে গেছে স্কুনারটার শরীর।
এতক্ষণে আমার সত্যিকার মৃত্যুভয় জেগে উঠল। ক্যারিবোর ছুরির মুখে তত বেশি ভয় পাই নি, কারণ জীবনে এমন অবস্থায় অনেকবার পড়েছি। কিন্তু এবার সাক্ষাৎ যম স্বয়ং সমুদ্র।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঁকি দিলুম। মড়ার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। অন্ধকার সমুদ্র ভয়ঙ্কর গর্জন করছে। স্কুনারে কোথাও আলো নেই। কোনও সাড়া শব্দ নেই। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে আছে। স্কুনারটা অসহায়ভাবে মোচার মতো প্রচণ্ড দুলছে। প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে ছিটকে সমুদ্রে গিয়ে পড়ব। তার ওপর মুহুর্মুহু জলের ঝাঁপটানি। ভিজে নাকাল হয়ে গেছি। কাঁপুনি শুরু হয়েছে ঠাণ্ডায়।
তাহলে কি এই সমুদ্রসমাধিই বরাতে ছিল আমার? অতিকষ্টে ওপরের ডেকে হাঁটু দুমড়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে এগিয়ে গেলুম। সমুদ্রের গর্জনে কান পাতা দায়। বৃষ্টি ঝাঁকে ঝাঁকে সূচ বেঁধাচ্ছে শরীরে। ওপরের কেবিনের কাছে যেতেই বিদ্যুৎ ঝিলিক দিল। সেই আলোয় দেখলুম, একটা ছায়ামূর্তি কী একটা টানাটানি করছে।
আবার বিদ্যুৎ ঝিলিক দিল। লোকটাকে চিনতে পারলুম। পিওবেদেনে।
আসন্ন মৃত্যুর মুখে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না।
ঝাঁপিয়ে পড়লুম তার ওপর। তবে রে হতচ্ছাড়া বদমাস। এবার তোর কী হয়?
পিওবেদেনে বেকায়দায় পড়ে মাতৃভাষায় কী সব আওড়াতে থাকল। তাকে জাপটে ধরে ভিজে ডেকের ওপর ফেলে হাঁকতে হাঁকতে বললুম, কীরে ব্যাটা? আমার শ্বাসনলী কাটবি বলেছিলি যে বড়? এবার দ্যাখ, কে কার শ্বাসনালী কাটে!
পিওবেদেনে গোঙাতে গোঙাতে বলল, কিন্তু তুমিও কি রক্ষা পাবে ভাবছ? সমুদ্র তোমাকে। গিলে খাবে। বরং তার চেয়ে আমাকে সাহায্য করো। তাহলে দুজনেই প্রাণে বাঁচব।