সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, আপনি প্রিয়বর্ধন না? রোমিলার বাড়িতে আপনাকে দেখেছি।
প্রিয়বর্ধন খিকখিক করে হাসল। কে প্রিয়বর্ধন? আমার নাম অ্যানথুপা পিদ্রু।
ক্যারিবো ভুরু কুঁচকে আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। বললুম, আশ্চর্য তো?
ক্যারিবো একটু হাসল! চেহারার এমন মিল হতেই পারে। একবার চিনে গিয়ে সব চীনাকে আমার একই নোক মনে হত।
কিন্তু এ ভুল আমার হতেই পারে না। জেদ করে বললুম, না মিঃ ক্যারিববা! ইনি তিনিই বটে। কারণ মিঃ রাজাকোর বাড়িতে আজ সকালে এঁকে দেখেছি। একটু আগে শুনলুম, উনি নিপাত্তা হয়েছেন…
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রিয়বর্ধন আমার ওপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি এর জন্য তৈরি ছিলুম না! শক্ত ডেকের ওপর বেকায়দায় পড়ে গেলুম। প্রিয়বর্ধন আমার বুকে বসে চেঁচিয়ে উঠল, ক্যারিববা! এ ব্যাটা সরকারি গুপ্তচর। এর মুখ বন্ধ করতে হবে। শিগগির!
ক্যারিবো চাপা গলায় কাদের ডাকল। আমি যথাসাধ্য লড়ে যাচ্ছি, কিন্তু আরও দুজন বেঁটে হিংস্র চেহারার লোক কেবিন থেকে বেরিয়ে এল। ক্যারিবো বিকৃত মুখে বলল, একে বেঁধে নিচে নিয়ে এস।
নাইলনের মজবুত দড়িতে আমাকে ওরা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। তারপর ধরাধরি করে সিঁড়ি বেয়ে জাহাজের খোলে নিয়ে গেল। নিচের কেবিনে পাটাতনের ওপর আমাকে ফেলে ক্যারিবো আমার পেটে জুতোসুদ্ধ একটা পা চাপিয়ে নিষ্ঠুর হেসে বলল, তা হলে তুমি সরকারি ঘুঘু? বোসো, দেখাচ্ছি মজা।
তারপর সে পকেট থেকে কী একটা বের করল। দেখেই আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেলুম। ক্যারিবোর হাতে একটা চকচকে বাঁকা ছুরি।…
০৭. অন্ধকার সমুদ্রে
জীবনে ভুলেও ঈশ্বরকে ডাকিনি। এখন মনে হল ঈশ্বরকে ডেকে দেখলে হয়। নইলে আমার মৃত্যুটা ঠেকানোর কোনও উপায় দেখছি না। অবস্থাটাও বড় বেকায়দা যে! ব্যাটারা নাইলনের দড়িতে আমাকে এমন করে বেঁধেছে, একটুও নড়াচড়া করা যাচ্ছে না, এদিকে শয়তান ক্যারিববা বাঁকা চকচকে ছুরিটা বাগিয়ে আমার বুকে তার থ্যাবড়া জুতোসুদ্ধু পা চাপিয়ে কুতকুতে চোখে তাকিয়ে আছে আর শাসাচ্ছে।
কিছুক্ষণ আগে কী ভদ্র আর অমায়িক চেহারা দেখেছিলুম লোকটার! এখন মনে হচ্ছে, বাস্তবিক যদি শয়তান বলে কেউ থাকে, তাহলে এই ব্যাটাই সে। এদিকে পিওবেদেনে ওরফে অ্যানথুপা পি পাশে দাঁড়িয়ে শিগগির আমার শ্বাসনালী কেটে ফেলার প্ররোচনা দিচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা করছি, এখনই বুঝি ক্যারিবো আমার গলায় ছুরি চালিয়ে দেবে।
মাথা ঠিক রাখার চেষ্টা করে বললুম, দেখুন মিঃ ক্যারিববা, আপনারা ভুল করছেন। আমি সত্যি সরকারি গুপ্তচর নই। আমার বুক পকেটে একটা কার্ড আছে। ওটা দেখলেই আমার পরিচয় পেয়ে যাবেন।
ক্যারিবো নূর হেসে বলল, পিওবের্দেনে যখন বলেছে, তখন তার কথাই ঠিক। তুমি সরকারি ঘুঘু।
না মিঃ ক্যারিবো আমি একজন সাংবাদিক মাত্র। আপনি ওর কথায় ভুল করবেন না।
পিওবের্দেনে বলল, তাহলে প্রফেসর বিকর্ণ আর ওই দাড়িওয়ালা বুড়ো কর্নেলের সঙ্গে কিসের সম্পর্ক তোমার?
কোনও সম্পর্ক নেই। আমি কিওটা দ্বীপে ওঁদের ভিযানের খবর নিতে এসেছি। সেই খবর কলকাতায় আমার কাগজে পাঠাতে হবে। বিশ্বাস না হলে আমা বুকপকেটের কার্ডটা আপনারা দেখুন।
পিওবেদেনে আমার বুকপকেট থেকে আইডেনটিটি কার্ডটা বের করে নেড়েচেড়ে দেখল তারপর ক্যারিববাকে কার্ডটা দিল সে। ক্যারিবো পড়ে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল এটা যে জাল নয় তার প্রমাণ? আমি জানি, সরকারি ঘুঘুদের জাল পরিচয়পত্র থাকে।
পিওবের্দেনে বলল, আর দেরি কোরো না ক্যারিববা আমাদের রওনা দেওয়ার সময় হয়ে এল।
ক্যারিবো কার্ডটা আমার পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বলল, পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে সরকারি ঘুঘু জাহান্নামে যাক। তবে পিওবেদেনে, আমার মনে হয় কাজটা মাঝদরিয়ায় সেরে ফেলাই ভাল। কারণ জল পুলিশ নজর রেখেছে। রক্তমাখা মড়া সমস্যা বাধাবে।
পিওবের্দেনে ভেবেচিন্তে বলল, ঠিক বলেছ। মাঝদরিয়ায় পৌঁছে ওর শ্বাসনালী কেটে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেব। আর কেউ খুঁজে পাবে না।
ক্যারিববা পা তুলে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, তারপর ওর সদগতির কোনও অসুবিধে হবে না। হাঙরেরা খিদেয় ছটফট করে বেড়াচ্ছে।
ওরা বেরিয়ে যাচ্ছিল। ডেকে বললুম, মিঃ ক্যারিববা, মেরেই যখন ফেলবেন, তখন দয়া করে দড়ির ফাঁসগুলো একটু আলগা করে দিন না। বড় ব্যথা করছে যে!
পিওবেদেনে! মুখ ভেংচে বলল, ব্যথা করছে! করবেই তো! ঘুঘু দেখেছ বাছাধন, ফাঁদ তো দেখোনি!
মিঃ পিওবেদেনে! রোমিলার বাবার জাদুঘর থেকে যে দেবী মূর্তিটা নিয়ে এসেছেন, ওর ভেতর কিন্তু কিওটা দ্বীপের সন্ধান পাবেন না—যদিও ওটা কিওটা দ্বীপের কাঠ দিয়ে তৈরি।
আমার এই চালে কাজ কাজ হল। ওদের দুজনের মুখেই চমক জাগল। ক্যারিববা বলল, , তুমি তাহলে দেখছি অনেক খবর রাখো?
রাখি বৈকি! আমি সাংবাদিক যে!
পিওবেদেনে আমার পাশে এসে হাঁটু মুড়ে বসে বলল, যদি সত্যি তুমি কিওটা দ্বীপের সন্ধান জানো, তাহলে তোমার শ্বাসনালী কাটা যাবে না।
ক্যারিবো বলল, চালাকিতে ভুলো না পিওবেদেনে! গুপ্তচররা বড় ধূর্ত।
বললুম, রাজাকো কিন্তু তার চেয়েও ধূর্ত ছিলেন। তাই কিওটা দ্বীপে যাওয়ার ম্যাপখানা কাত্তির গায়ে এঁকে রেখে গেছেন।
দুজনে আবার চমকে উঠল। এক গলায় বলল, কাত্তি! কাত্তি!
হ্যাঁ, কাত্তি।
ক্যারিবো ব্যস্তভাবে বলল, কোথায় আছে সেই কাত্তি?