- বইয়ের নামঃ সবুজ বনের ভয়ংকর
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কর্নেল সমগ্র
০১. কথা বলা বন
মার্চের এক রবিবারের সকালে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ফ্ল্যাটে অভ্যাসমতো আড্ডা দিতে গিয়ে দেখি, বৃদ্ধ ঘুঘুমশাই অফিসের বড়কর্তার মতো একটা ফাইল খুলে গোমড়ামুখে বসে আছেন। কাছাকাছি বসে ফাইলের বিষয়বস্তু আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছু ঠাহর করা গেল না। আমার উপস্থিতিও যেন উনি টের পেলেন না।
একটু পরে ওঁর মুখ দিয়ে কী একটা কথা বেরুল। মনে হল বঙ্গভঙ্গ কিংবা এরকম কিছু। কথাটা উনি বিড়বিড় করে আওড়াতে শুরু করলে আর চুপ করে থাকা গেল না। বললাম, বঙ্গভঙ্গ ততো ১৯৪৭ সালে হয়ে গেছে। এতকাল বাদে ও নিয়ে দুঃখ করার কী আছে?
কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন এবার। ও তুমি এসে গেছ দেখছি ডার্লিং। তোমার কথাই ভাবছিলাম। একটু অপেক্ষা করো। কিছুক্ষণের মধ্যে এক ভদ্রলোক আসবেন এবং তোমার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য কিছু মালমশলা তার কাছে পেয়ে যাবে।
একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, আজ আমার ছুটির দিন। খবরের কাগজের জন্য আজ আমার এতটুকু মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আপনি হঠাৎ বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বিড়বিড় করে মরাকান্নার মতো শোকপ্রকাশ করছিলেন কেন?
বঙ্গভঙ্গ? কর্নেল ভুরু কুঁচকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর জোরে হেসে বললেন, না জয়ন্ত। রঙ্গো রঙ্গে। কোহাও রঙ্গে রঙ্গো।
তার মানে?
স্পিকিং উডস। কথা বলা বন। প্রশান্ত মহাসাগরের পলিনেশীয় এলাকার ছোট্ট দ্বীপ ইস্টার আইল্যান্ডের লুপ্ত ভাষায় কোহাও রঙ্গো রঙ্গো মানে যে বন কথা বলতে পারত।
এই সময় ষষ্ঠীচরণ এসে খবর দিল, এক সায়েব এসেছেন। তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা করে নিয়ে এলেন কর্নেল। তারপর পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার সঙ্গে। সায়েবের নাম কাপ্তেন জর্জ ব্যুগেনভিলি। সওদাগরী জাহাজে সারা পৃথিবী চক্কর মেরেছেন। নামটা শুনে বললাম, আপনার নামের সঙ্গে কি বুগানভিলিয়া ফুলের কোনও সম্পর্ক আছে?
সায়েব আমুদে স্বভাবের মানুষ। গড়ন প্রকাণ্ড কুমড়োর মতো। উঁড়ি দুলিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, আলবৎ আছে। বুগানভিলিয়া ফুল আসলে পলিনেশীয়। ১৭৬৮ সালে আমার মতো এক কাপ্তেন আঁতোয়াঁ দ্য বুগেভিলি ওই এলাকার একটা দ্বীপে এ ফুল আবিষ্কার করেন। ইউরোপে নিয়ে যান। তার নামেই ফুলের নাম চালু হয়।
কর্নেল যোগান দিলেন, উষ্ণ নিরক্ষরেখা অঞ্চলের উদ্ভিদ। নিস্টাজিনিসিয়া গোত্রের প্রজাতি।
মুচকি হেসে বললাম, কির্নেল, আপনার কোহাও রঙ্গো রঙ্গোর সঙ্গে বুগানভিলিয়া ফুল এবং মাননীয় অতিথি কাপ্তেন সায়েবের নামের এই যোগাযোগ সম্ভবত আকস্মিক নয়। তাই না?
কর্নেল সেই ফাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। কাপ্তেন ঝুগেনভিলি সেটার দিকে চোখ। বুলিয়ে বললেন, রাতারাতি জেরক্স কপি তৈরি দেখছি! কর্নেল, আপনার এই উৎসাহ দেখে আমার আশা হচ্ছে, এতদিনে কিওটা দ্বীপের বৃক্ষরহস্য ফাঁস করাটা আর কঠিন হবে না।
ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি রেখে গেল। ওঁরা কফি খেতে খেতে কথা বলছিলেন। আমি ফাইলে চোখ রাখলাম। তারপর যত পাতা ওল্টাই, তত চমক জাগে। একি সত্যি, না নিছক গালগল্প?
…তিন বছর আগে তাহিতি থেকে অস্ট্রেলিয়া হয়ে ফেরার সময় ইচ্ছা ছিল কিওটা দ্বীপ সম্পর্কে খোঁজখবর নেব। কিন্তু কোকোস দ্বীপপুঞ্জ এলাকা যেন গোলকধাঁধা। তার ওপর উল্টো বাতাস। এগোনো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। এ দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান ভারত মহাসাগরে। অক্ষাংশ ২০ ডিগ্রি, দ্রাঘিমাংশ ৮০ ডিগ্রি। পঞ্চাশ নটিকাল মাইল দূরত্বে পৌঁছতেই হঠাৎ প্রবল দক্ষিণগামী বাতাস আমার জাহাজ এনডেভার কে ঠেলে দিল বিপরীত পথে। চাগোস দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখান থেকে মরিশাস হয়ে কেপটাউন। তারপর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলাম। লন্ডনে পৌঁছে কিছুকাল মিউজিয়াম এবং লাইব্রেরি ছুঁড়ে কিওটা দ্বীপের রহস্য নিয়ে মাথা ঘামালাম…
সিঙ্গি ট্রিজ! সঙ্গীতকারী বৃক্ষ! কী অদ্ভুত কথা! অসংখ্য নাবিক এই উদ্ভট গল্পে বিশ্বাস করে। নিশ্চয় কানের ভুল। গাছপালার ফাঁক দিয়ে বাতাস বইলে অনেক সময় গানের সুর বলে ভুল হতে পারে। কিন্তু ঐতিহাসিক দলিলপত্রে দেখলাম, কিওটার গাছগুলো নাকি কথাও বলতে পারে।
আমার এবারকার অভিযান আন্টার্কটিকায়। নাবিকদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাগোেস থেকে দক্ষিণে। না এগিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে কোকোসের দিকে এগিয়েছিলাম। কাল সন্ধ্যায় কিওটার একমাইল দূরে নোঙ্গর বেঁধেছি আমার রেজিলিউশান জাহাজকে। ২৪ নভেম্বর কেপটাউন ছেড়েছি। আজ ১২ ডিসেম্বর। আবহাওয়া চমৎকার নাতিশীতোষ্ণ এখানে। সকালে একটা বোট নিয়ে তিনজন দ্বীপের দিকে এগিয়ে গেলাম। চমৎকার বেলাভূমি। ডাঙায় পৌঁছেই আমার যা অভ্যাস—বক ছুড়লাম একবার। তারপর ইউনিয়ন জ্যাক পুঁতে দিলাম। সমুদ্রপাখিরা কলরব করে উড়ে গেল। নিশ্চয় দ্বীপটাতে মানুষ বাস করে না। তাহলে বন্দুকের শব্দ শুনে তারা ছুটে এসে ভিড় করত। ডাক্তার স্মিথকে বললাম, চলুন তা হলে। ডাঃ স্মিথ কান খাড়া করে কী শুনছিলেন। বললেন, কে যেন চিৎকার করে কিছু বলল। হাসতে হাসতে উঁচু জায়গাটাতে উঠে গেলাম। আমার পেছনে ডাঃ স্মিথ আর দুজন সশস্ত্র নাবিক। সামনে ঘন জঙ্গল। বিশাল উঁচু সব অপরিচিত গাছ। স্বীকার করছি, গাছগুলো দেখে কেমন গা ছমছম করছিল। যেন তারা প্রাণীর মতো সচেতন এবং আমাদের নিঃশব্দে লক্ষ্য করছে। সেই গাছপালার ভেতর দিয়ে কয়েক পা এগিয়েছি, ঠিক যেন বাতাসের শব্দে শনশন করে কোথায় একদল মানুষ ইংরেজি ভাষায় গর্জন করে উঠল স্টপ ইট!… স্টপ ইট।