কী বিগ্রহ?
রাধা-কৃষ্ণ। বলে শচীনবাবু কপালে দুহাত জোড় করে ঠেকালেন। গাঢ় স্বরে ফের বললেন, বংশের প্রাচীন বিগ্রহ। আমরা পুরুষানুক্রমে বৈষ্ণব। পাঁচশো বছরের প্রাচীন বিগ্রহ স্বয়ং শ্রীচৈতন্যের হাত থেকে আমার পূর্বপুরুষ আশীর্বাদ স্বরূপ পেয়েছিলেন।
কোনও রত্ন ছিল বিগ্রহে?
ছিল। বাজারদরের কথা যদি ধরেন, তবে তার দাম তত কিছু নয়। কিন্তু যদি ইতিহাস এবং আর্টের প্রশ্ন তোলেন, বলব–ওই বিগ্রহ দুর্লভ।
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, রেয়ার আর্ট?
শচীনবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, রেয়ার আর্ট কী বলছেন? রেয়ারেস্ট আর্ট!
বেস্ট!
অ্যাঁ? শচীনবাবু রুষ্ট মুখে আমার দিকে তাকালেন।
কর্নেল দ্রুত বললেন, আচ্ছা মিঃ মুখার্জি, আপনারা ব্রাহ্মণ। তো আপনি ৪ নিজেই পুজো করতেন, নাকি পুজোর জন্য সেবায়েত ঠাকুর রেখেছিলেন?
শচীনবাবু অন্যমনস্কভাবে বললেন, আমি মশাই কোর্টকাছারি করতাম। ওকালতি পেশা। মিথ্যাকে সত্য, আবার সত্যকে মিথ্যা করা ছিল আমার কারবার। আমি স্পষ্ট কথা পছন্দ করি। নিজে পুজোর মতো পবিত্র কর্ম করতে সংকোচ হত তাই ঠাকুর রেখেছিলাম। বংশের আরাধ্য বিগ্রহের সেবা-যত্ন, তারপর দোল বা রাসপূর্ণিমা ইত্যাদির বাৎসরিক সব অনুষ্ঠান ঠাকুরমশাই-ই সামলাতেন। আমার অত সময়ই বা কোথায়?
বিগ্রহ কীভাবে চুরি গিয়েছিল?
ঠাকুরঘরের তালা ভেঙে চোর ঢুকেছিল। ভোরে গঙ্গাস্নান করতে যাওয়ার সময় ঠাকুরমশাই দেখেন দরজার তালা ভাঙা। ভেতরে বিগ্রহ নেই। পুলিশ এল। বাড়ির লোকজন বলতে আমি, আমার স্ত্রী, একমাত্র মেয়ে, এবং কর্মচারী ঝি-চাকর-দারোয়ান এরা। পুলিশ জেরা করে চলে গেল। সন্দেহ করার মতো কাউকে পায়নি। সেই রাত্রে ঠাকুরমশাই মনের দুঃখে আত্মহত্যা করেছিলেন। শচীনবাবু ভিজে কণ্ঠস্বরে বললেন, একটু পাগলাটে সাধকটাইপ লোক ছিলেন। তো হরি যদিও রাত্রে পাইকপাড়ায় নিজের বাসায় থাকত, আমার কেন যেন তার ওপরেও সন্দেহ হয়েছিল। এত বছর পরে আর মনে নেই কেন ওকে সন্দেহ করেছিলাম।
আপনি ওঁর মামাতো ভাই শ্যামসুন্দরকে চিনতেন?
নামটা চেনা ঠেকছে। শ্যামসুন্দর–বলে শচীনবাবু কিছুক্ষণ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, হরি মাঝে মাঝে তার এক আত্মীয়কে এনে চাকরির জন্য সুপারিশ করত মনে পড়ছে। সে-ই কি?
আচ্ছা মিঃ মুখার্জি, হরিবাবুর এ বাড়িতে গতিবিধি কি অবাধ ছিল?
তা ছিল। আমার কর্মচারীদের আমি নিজের ফ্যামিলির লোক মনে করতাম। এখনও করি। এখন অবশ্য আর অত লোক নেই। দরকারও হয় না।
হরিবাবু তার সেই আত্মীয়কে নিয়ে এ বাড়ি আসতেন কি?
এসে থাকবে। মনে নেই।
কেন হরিবাবুকে সন্দেহ হয়েছিল, মনে পড়ছে না?
শচীনবাবু নড়ে বসলেন। ও! হ্যাঁ। আমার এক কর্মচারী আমার বৈমাত্রেয় ভাই তরুণের বাড়ি থেকে হরিকে বেরুতে দেখেছিল। বিগ্রহ চুরির কিছুদিন আগে। পুলিশ তরুণকে জেরা করেছিল। তরুণ বলেছিল, হরিহ্যাঁ, ওর সেই আত্মীয়ের চাকরির জন্য নাকি গিয়েছিল। তবে আজও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তরুণই বিগ্রহ চুরি করিয়েছিল। ওর মতো বদমাইস আর দুটি নেই। দেশবিদেশে ব্যবসা করে। বিদেশে ওই বিগ্রহ বেচে বহু টাকা দাম পেয়েছে। জানেন? তরুণ দুনম্বরি ব্যবসা করে। নিষিদ্ধ মাদক। বুঝলেন? আমি ওকে এবার ধরিয়ে দেব। জেল খাঁটিয়ে ছাড়ব।
মিঃ মুখার্জি, হরিবাবুর নাকের বাঁ পাশে কি প্রকাণ্ড জডুল ছিল?
আইনজীবী হঠাৎ এই প্রশ্নে খাপ্পা হয়ে গেলেন। আপনি ও মাসে এসে আমার বরমডিহির বাড়ি সম্পর্কে একটা ভুতুড়ে গল্প ফেঁদে গেলেন। আজ এসে আবার হাজারটা প্রশ্ন।
প্লিজ মিঃ মুখার্জি–
শচীনবাবু মুখ বিকৃত করে বললেন, হরির নাকের পাশের জঙুল নিয়ে আপনার মাথাব্যথা কেন? হঠাৎ জডুলের কথা আসছে কোথা থেকে, বুঝি না।
তাহলে ছিল?
জডুলটা বিচ্ছিরি দেখাত বলে বলতাম, অপারেশন করে নিও। নিয়েছে কি কে জানে?
অপারেশন করে নিয়েছেন।
তা হঠাৎ জডুল নিয়ে পড়লেন কেন? হরিকে আপনি চিনলেন কী করে?
কর্নেল হাসলেন। আলিপুর কোর্টে আমার এক আত্মীয়ের একটা মামলা চলছে। সেই সূত্রে আলাপ হয়েছে হরিবাবুর সঙ্গে। টাইপিস্টের কাজ করেন। কথায় কথায় বলছিলেন, আপনার ক্লার্ক ছিলেন।
আমার নিন্দে করছিল নাকি?
না, না। খুব সুখ্যাতি করছিলেন।
আইনজীবীর মুখ দেখে মনে হল, কথাটা বিশ্বাস করলেন না। বললেন, যাক গে। আপনার আসার আসল উদ্দেশ্য কী, এবার খুলে বলুন। আমি স্পষ্ট কথা ভালবাসি। আপনি কর্নেল সায়েব বলেই এতক্ষণ কথা বলছি। একজন পরিচারক এতক্ষণে চায়ের ট্রে আনল। আইনজীবী খেঁকিয়ে উঠলেন, তোদের চৌদ্দ মাসে বছর! দুকাপ চা করতেই–নিন কর্নেল সায়েব! চা খান। কিছু মনে করবেন না। মাঝে মাঝে আমার মেজাজ কেমন বিগড়ে যায় আজকাল। কীভাবে যে বেঁচে আছি! একে বাঁচা বলে?
ভদ্রলোকের কথাবার্তার ভঙ্গি দেখে আমারও মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কর্নেলের দেখাদেখি চায়ের কাপ হাতে নিতে হল। তাছাড়া বিগ্রহ চুরির ঘটনা সেই কালো নোটবইয়ের ওয়ার্ডগেমের সঙ্গে জড়িয়ে রহস্য সত্যিই ঘনীভূত হয়ে উঠেছে এবার।
কর্নেল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, আপনার ঠাকুরঘর থেকে ঐতিহাসিক পবিত্র বিগ্রহ চুরি গিয়েছিল। পুলিশ তা আজ পর্যন্ত উদ্ধার করে দিতে পারেনি। আমার মনে হচ্ছে, বিগ্রহ এখনও বিদেশে পাচার হয়নি। কোথাও তা লুকানো আছে। যদি আপনি এই প্রশ্নটার উত্তর সঠিক দেন, তাহলে আমি হয়তো বিগ্রহ উদ্ধার করে দিতে পারব।