ডার্লিং! তুমি ওয়ার্ডগেমের পাল্লায় পড়েছ। আজকাল বিদেশে কুইজ খুব চালু। সেই কুইজ!
ওঁর কথা গ্রাহ্য না করে আঙুল গুনে হিসেব করতে থাকলাম। বললাম, একটা কাগজ দিন। দেখি কী দাঁড়াচ্ছে।
কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা প্যাড বের করে দিলেন। আমি হিসেব করে একটা ছক সাজিয়ে ফেললাম ইংরেজি বর্ণমালার সংখ্যার ভিত্তিতে। এ-কে ১ ধরে ছকটা সাজালাম।
৭ ১৮ ১ ২
১৮ ১ ১৮ ৫
১ ১৮ ২০ ৫
২ ৫ ১৯ ২০
কর্নেলকে কাগজটা দেখিয়ে বললাম, লম্বালম্বি ধরলে ২৮, ৪২, ৫৮ এবং ৩২ পাচ্ছি। পাশাপাশি ধরলে ২৮, ৪২, ৪৪ এবং ৪৬ পাচ্ছি। এবার দেখুন ২৮+৪২+৫৮+৩২=১৬০দাঁড়াচ্ছে। আবার ২৮+৪২+৪৪+৪৬=১৬০ দাঁড়াচ্ছে। কর্নেল! লম্বালম্বি এবং পাশাপাশি যোগ দিলে দুদিকেই যোগফল ১৬০। এটা নিশ্চয় কোনও সংকেত!
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে শুধু বললেন, বাহ্!
আরও উৎসাহী হয়ে বললাম, এবার ইংরেজি অক্ষরগুলো দেখা যাক। এই ABEGRST ৭টা অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে।
এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল বললেন, ফোনটা ধরো, জয়ন্ত!
টেলিফোন তুলে সাড়া দিতেই কেউ কড়া ধমক দিল, এই ব্যাটা বুড়ো ঘুঘু!
নোটবইটা কেন নিয়ে এসেছিস? হরিকে ফেরত না দিলে টাক ফুটো করে দেব। ব্যাটা ঘুঘু হয়েছ। ফাঁদ দেখনি?
তারপর লাইন কেটে গেল। টেলিফোন রেখে বললাম, হুমকি দিল কেউ।
কী হুমকি?
কথাগুলো বললাম। আমার হাত কাঁপছিল। কর্নেলকে পুলিশ মহলে আড়ালে ঠাট্টা করে বুড়ো ঘুঘু বলে। লোকটা দেখছি কর্নেলকে বিলক্ষণ চেনে এবং হরিবাবুকে ফলো করে এসেও থাকবে। আমাদের গতিবিধির দিকেও নজর রেখেছে। শীতের মধ্যে গায়ে ঘাম ঝরা গরম টের পাচ্ছিলাম।
কর্নেল হাসলেন। হুঁ। রহস্য ঘনীভূত বলা চলে। তবে তোমাকে ওয়ার্ডগেমের ভূতে পেয়েছে জয়ন্ত! সাবধান!
বললাম, ১৬০ নাম্বারটা কি কোনও সংকেত বলে মনে হচ্ছে না আপনার?
কর্নেল দাড়ি নেড়ে বললেন, । তারপর কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানার পর টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন। একটা নাম্বার ডায়াল করে বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। মিঃ মুখার্জিকে দিন না প্লিজ! মিঃ মুখার্জি? হ্যাঁ। আপনার সঙ্গে একটু জরুরি কথা আছে।…না। ফোনে বলা যাবে না। মুখোমুখি…ঠিক আছে। কাল সকালে ৯টায় যাচ্ছি। …ধন্যবাদ রাখছি।
কান খাড়া করে শুনছিলাম। বললাম, মিঃ মুখার্জি মানে কি সেই রিটায়ার্ড অ্যাডভোকেট শচীনবাবু?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। তুমি ইচ্ছে করলে সঙ্গী হতে পারো। না কি উড়োফোনের হুমকিতে ভয় পেয়ে গেছ?
বললাম আপনার সঙ্গে থাকলে যমরাজকেও ভয় পাই না!
কিন্তু তোমার মুখে অস্বস্তির ছাপ!
নাহ্। ও কিছু নয়।
তবে ডার্লিং! ওয়ার্ডগেমের ভূত তোমাকে একটা অঙ্ক উপহার দিয়েছে। সত্যি ওয়ার্ডগেমের ভূত আমাকে পেয়ে বসেছিল। বাড়ি ফিরে অনেক রাত্রি পর্যন্ত সেই ছকটা নিয়ে অনেক জল্পনা এবং আঁক কষাকষি চলেছিল। শেষে ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সে-রাত্রে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। খুনখারাপি, ভূতপ্রেত, আবার কখনও পরীক্ষার হলে বসে অঙ্কের পরীক্ষা দিচ্ছি কিন্তু কিছুতেই অঙ্ক কষতে পারছি না, এইসব দুঃস্বপ্ন।
সকালে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে শুনলাম, কিছুক্ষণ আগেই হরিবাবু সেই কালো নোটবইটা নিয়ে গেছেন। কর্নেল আমার অপেক্ষা করছিলেন। আমরা ভবানীপুরে অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবীর বাড়ি রওনা হলাম।
বাড়িটা কলকাতার আর সব বনেদি অভিজাত বংশীয়দের বাড়ির মতো বিরাট। মস্ত গেট এবং সুদৃশ্য লন। চারদিকে উঁচু দেওয়াল ঘেরা আছে। মধ্যিখানে দোতলা পুরনো আমলের বিলিতি স্থাপত্য। বড় বড় থাম। ফুলবাগানে মর্মরমূর্তি।
একটা লোক আমাদের বসার ঘরে অপেক্ষা করতে বলে গেল। কর্নেল বললেন, শচীনবাবুর চেম্বার ছিল ওপাশের একটা আলাদা বাড়িতে। সেটা এখন নার্সিংহোম। এক ডাক্তারকে ভাড়া দিয়েছেন। শচীনবাবুর ছেলে নেই। এক মেয়ে। সে স্বামীর কাছে আমেরিকায় থাকে।
ভেতরকার দরজার পর্দা তুলে নাদুসনুদুস চেহারার এক ভদ্রলোক বেরুলেন। তার হাতে একটা ছড়ি। কর্নেল নমস্কার করে বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরি।
শচীনবাবু ভুরু কুঁচকে আমাকে দেখে বললেন, খবরের কাগজের লোক সঙ্গে এনেছেন কেন কর্নেল সায়েব? পাবলিসিটি ব্যাপারটা আমি পছন্দ করি না।
কর্নেল হাসলেন। না না। ও আমার তরুণ বন্ধু। সময় পেলেই আমার সঙ্গী হয়।
যাক গে। বলুন কী ব্যাপার! বলে আইনজীবী বসলেন। মনে হল বাতের অসুখে ভুগছেন। একটা পা ছড়িয়ে দিলেন। গায়ে গলাবন্ধ লম্বা কোট। মাথায় মাফলার জড়ানো এবং পরনে পাজামা। পায়ে মোজা ও পামসু।
কর্নেল বললেন, হরিচরণ গাঙ্গুলি নামে কেউ একসময় আপনার ক্লার্ক ছিলেন?
হরি? আইনজীবী নিস্পলক চোখে তাকালেন। হরির আবার কী হল? শুনেছি, সে তো এখন আলিপুর কোর্ট চত্বরে বসে টাইপ করে। ভালই কামায়।
মিঃ মুখার্জি! উনি আপনার ক্লার্ক ছিলেন কি না জানতে চাইছি।
ছিল। কিন্তু কেন জানতে চাইছেন?
ওঁকে কি আপনি কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন, নাকি উনি নিজে থেকেই কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন?
শচীনবাবু একটু গুম হয়ে থাকার পর বললেন, ছাড়িয়ে দিয়েছিলাম। প্র্যাকটিস ছেড়ে দিলেও ওকে রাখতাম। অন্য কাজ অনেক ছিল। করাতাম! কিন্তু আমার ঠাকুরঘর থেকে বিগ্রহ চুরি গেল। যাকে-যাকে সন্দেহ হয়েছিল, হরি তাদের একজন।