মোট চারটে ছবি। ঝুল জমে আছে। আর একটা ছবি রাধাকৃষ্ণের। কর্নেল সেটার কাছে গেলে হরিবাবু বললেন, শচীনবাবুদের গৃহদেবতার ফোটো স্যার! ওঁদের ভবানীপুরের বাড়ির ঠাকুরঘরে প্রতিষ্ঠিত। শচীনবাবুর ইচ্ছে ছিল, শেষজীবনে বরমডিহিতে গিয়ে কাটাবেন। এই বিগ্রহ সেখানে নিয়ে যাবেন। কিন্তু বৈমাত্রেয় ভাইয়ের সঙ্গে মামলা বেধে গেল।
রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের ছবির নীচের দেওয়ালে সিঁদুরের ছোপ এবং কালো দাগ দেখে বোঝা গেল হরিবাবু ভক্তিমান। তিনি নিশ্চয় কোর্টে যাওয়ার আগে ধূপধুনো জ্বেলে প্রণাম করে তবে বেরোন। কালো দাগগুলো ধূপকাঠিরই হবে।
কর্নেল বললেন, শ্যামবাবু এসে শুতেন কোথায়?
মেঝেয় বিছানা করে দিতাম। মশারি কিনতে হয়েছিল ওর জন্য। যা মশা।
আপনি আপনার তক্তাপোশের তলা খুঁজেছেন?
তন্নতন্ন খুঁজেছি। আপনিও খুঁজে দেখুন। বলে হরিবাবু টর্চ বের করলেন।
থাক। বলে কর্নেল আবার বিগ্রহের ছবির কাছে গেলেন। ছবিটা আন্দাজ ৬ ফুট বাই ৪ ফুট সাইজের ফ্রেমে বাঁধানো। বললেন, এই ছবিটা নামাবেন একটু?
কে-কেন স্যার?
কর্নেল হাসলেন। আপনি ব্রাহ্মণ। এতে পাপ হবে না। ছবিটা নামান।
হরিবাবু ছবিটা সাবধানে দেওয়ালের পেরেক থেকে দুহাতে খুললেন। অমনই কালোরঙের ছোট্ট এবং পাতলা একটা নোটবই–ঠকাস করে পড়ে গেল নিচে।
কর্নেল সেটা দ্রুত কুড়িয়ে নিলেন। হবিবাবু চমকে উঠে বললেন, অ্যাঁ। এ কী!
আপনি সব ছবির ঝুল ঝাড়বেন বা পরিষ্কার করবেন, কিন্তু এটাতে হাত দেবেন না জেনেই শ্যামবাবু নোটবইটা এর আড়ালে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন।
হরিবাবু ছবিটা কপালে ঠেকিয়ে যথাস্থানে লটকে দিলেন। ধপাস করে বিছানায় বসে বললেন, শ্যামার কাণ্ড! ওঃ! আগে যদি জানতাম নোটবইটা ওখানেই আছে? তাছাড়া এইটুকু সাইজের নোটবই! আর আমি গঙ্গার ঘাটে বড় সাইজের কালো ডায়রি বই নিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। এখন বুঝতে পারছি, বদমাইস লোকটা দূর থেকে দেখেই টের পেত–ওঃ।
উনি কপালে মৃদু থাপ্পড় মারলেন অনুশোচনায়। তারপর কেঁদেই ফেললেন। আমারই বুদ্ধির দোষে শ্যামার প্রাণটা বেঘারে গেছে। হায়! হায়! কেন আমি ওখানে খুঁজিনি?
কর্নেল সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, যা হবার হয়ে গেছে। আপনি কীভাবে জানবেন একটা পবিত্র ছবির পেছনে এটা লুকোনো আছে? যাই হোক, আজ আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি, আমার দেখা দরকার, এর মধ্যে কী আছে যে কোনও সাংঘাতিক লোকের এটা এতই দরকার এবং বেচারা শ্যামাবাবুকে এর জন্যই প্রাণ হারাতে হল? আপনি কাল সকালে কোর্টে যাওয়ার পথে এটা আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন। তারপর বলব, কী করা দরকার।
হরিবাবু চোখমুছে বললেন, কিন্তু স্যার! বদমাসটার শাস্তি হবে না? ওকে আপনি ছেড়ে দেবেন?
আপনিই বলেছেন, নোটবই যাকে দেবেন, তাকে ধরে ফেললে আপনি পরে বিপদে পড়তে পারেন। আপনার জীবন বিপন্ন হতে পারে।
না, না। ধরবেন না সঙ্গে সঙ্গে। তাকে ফলো করবেন। হরিবাবু চাপা গলায় বললেন, তাছাড়া এ-একটা রীতিমতো রহস্য স্যার। এই রহস্যের কিনারা করা কি উচিত নয়? মহীবাবু বলছিলেন, আপনি বিখ্যাত রহস্যভেদী।
কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ। রহস্য আমাকে টানে। তবে সেটা পরের কথা। আপনাকে বাঁচিয়েই রহস্য ফাঁস করা উচিত কি না?
আজ্ঞে! ঠিক বলেছেন স্যার! আমি ছাপোষা মানুষ। দেশের বাড়িতে একদঙ্গল পুষ্যি।…
হরিবাবু চা খাওয়ার জন্য অনুরোধ করছিলেন। কর্নেল মশার উৎপাতের অজুহাত দেখিয়ে চলে এলেন। তবে এ-ও সত্যি, বিকেল যত ফুরিয়ে আসছিল, মশার অত্যাচারও তত বাড়ছিল। শীতে মশার উপদ্রব এমনিতেই বেড়ে যায়। তো এ একটা এঁদো জায়গা।
ইলিয়ট রোডে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। কর্নেল ষষ্ঠীকে কফি করতে বলে নোটবইটা নিয়ে বসলেন। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, শ্যামবাবুর ওয়ার্ডগেম খেলার অভ্যাস ছিল দেখছি। হুঁ, ক্রসওয়ার্ড পাজল। এ একটা বিচিত্র নেশা, জয়ন্ত! তবে এতে ভাষার শব্দজ্ঞান বাড়ে। বাহ! ভদ্রলোক রীতিমতো ইংরেজিতে পাকা ছিলেন। বোঝা যাচ্ছে, ইংরেজি পত্রিকায় ক্রসওয়ার্ড পাজ পাঠাতেন। অ্যাঁ? এটা তো ভারি অদ্ভুত!
কৌতূহলী হয়ে বললাম, দেখি! দেখি!
কর্নেল খুদে নোটবইটার একটা পাতা দেখালেন। তাতে একটা চৌকো ছকে এঁকে ইংরেজি অক্ষর লেখা।
G R A B
R A R E
A R T S
B E S T
বললাম, অসাধারণ! লম্বালম্বি বা পাশাপাশি পড়লেও চারটে একই শব্দ। গ্র্যাব, রেয়ার, আর্ট, বেস্ট। বলেই চমকে উঠলাম। কর্নেল! কিন্তু এই ইংরেজি শব্দগুলোর মানেতে কী যেন সংকেত আছে?
কী সংকেত?
উত্তেজিতভাবে বললাম, গ্রাব মানে–জোর করে দখল বা আত্মসাৎ করা। রেয়ার মানে–দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য। আর্টস–শিল্পকলা। সচরাচর চিত্রকলাই বোঝায়। বেস্ট সর্বোত্তম, সর্বোৎকৃষ্ট। তাহলে মোটামুটি মানে কী দাঁড়াচ্ছে দেখুন দুর্লভ এবং সর্বোৎকৃষ্ট চিত্রকলাগুলো আত্মসাৎ করো! তাই না?
ষষ্ঠীচরণ কফি দিয়ে গেল। কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, কফি খাও ডার্লিং! নার্ভ আরও চাঙ্গা হবে। আরও কিছু মানে বেরুতে পারে।
কফি খেতে খেতে নোটবইটার আরও পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। কিন্তু ক্রসওয়ার্ড পাজল ছাড়া আর কিছু নেই। আবার ওই পাতাটায় মন দিলাম। বললাম নাহ। এটা নিশ্চয় কোনও প্রাচীন দুর্লভ ছবি হারানোর কেস। এর মধ্যে কোনও সংকেত অবশ্যই আছে। কিন্তু যে এই নোটবইটা হাতাতে চায়, সম্ভবত সে-ই তার মর্মোদ্ধার করতে পারে। বলে একটুখানি চিন্তাভাবনা করে নিলাম। আচ্ছা। কর্নেল! ইংরেজি হরফগুলো যদি সংখ্যার ভিত্তিতে সাজাই