কেন ভাল নয়।
বাড়িটার বদনাম ছিল। ভূতপ্রেতের ব্যাপার আর কী! রাতবিরেতে কী সৎ শব্দ হত। আমিও শুনেছি স্যার!
কী শব্দ শুনেছেন?
একটা ঘরে হাঁটাচলার শব্দ। গোঙানির শব্দ। যেন কেউ–মানে ঠিক। বোঝাতে পারব না। মরণাপন্ন মানুষের চাপা আর্তনাদ। কিংবা–
হরিচরণের মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। কর্নেল বললেন, আচ্ছা হরিচরণবাব, ওই বাড়িতে আপনি তো ভৌতিক শব্দ শুনেছেন। কিছু ভৌতিক ব্যাপার কি দেখেছেন?
দেখেছি স্যার! হরিচরণের মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠল। সেবার দিন দশেক ছিলাম ওখানে। এক রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কে যেন পাশের ঘরে গোঙাচ্ছে। তো এ শব্দ আগের রাত্রেও শুনেছিলাম। তাই সাহস করে উঠে পড়লাম। শব্দটা দোতলার একটা ঘর থেকে আসছিল। ওই ঘরে পুরনো আসবাবপত্র ঠাসা ছিল। দরজা খুলোম। তালা আটকানো ছিল না। তো আমার হাতে টর্চ। টর্চ জ্বেলেই দেখি, ওঃ, সে কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য!
কী দৃশ্য?
একটা রক্তমাখা লোক পড়ে গোঙাচ্ছে।
তারপর?
হরিচরণ শ্বাস ছেড়ে বললেন, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! এক পলকের দেখা। তারপর দেখি কিছু নেই। তক্ষুণি দরজা বন্ধ করে কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এলাম। ওঃ।
এ কথা কাউকে বলেছিলেন?
না স্যার! হেসে উড়িয়ে দেবে বা আমাকে ভীতু বলবে বলে কাউকে বলিনি। আর উঁকিলবাবুর যা মেজাজ! ওঁর বাড়িতে ভূতের বদনাম সহ্য করতে পারতেন না। বলতেন, সব তরুণের চক্রান্ত! এখন আমি যদি ওঁকে বলি, রাত্রে ওই ঘরে রক্তাক্ত বডি দেখেছি, তাহলে কী হত ভাবুন!
আমি উসখুস করছিলাম। কর্নেল আমার দিকে চোখ কটমটিয়ে তাকালেন। বললেন, ঠিক আছে হরিচরণবাবু! আমরা ওবেলা আপনার বাসায় যাব। খুঁজে দেখা দরকার, সত্যি শ্যামবাবু আপনার ঘরে কোনও কালো নোটবই রেখে গেছেন কি না।
আমি খুঁজে দেখেছি স্যার। পাইনি। তবে আপনার চোখ। আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনিও খুঁজে দেখবেন। তাহলে উঠি স্যার! আমার প্রাণ আপনার হাতে। অনুগ্রহ করে–
কর্নেল আশ্বাস দিয়ে বললেন, ভাববেন না। আমি আপনাকে সাহায্য করব। আপনার নাম-ঠিকানাটা লিখে দিয়ে যান। বিকেল চারটে-সাড়ে চারটে নাগাদ আমরা যাব।
হরিচরণ পকেট থেকে একটা ছাপানো নেমকার্ড বের করে দিলেন। তারপর নমস্কার করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কর্নেল কার্ডটা দেখতে দেখতে বললেন, ভদ্রলোক রীতিমতো পেশাদার। তলায় ইংরেজিতে লেখা আছে, সবরকম আইন-আদালত সংক্রান্ত দলিলপত্র টাইপ করা হয়।
চাপা উত্তেজনায় অস্থির ছিলাম। বললাম, এই ভদ্রলোকও রক্তাক্ত বডি দেখেছিলেন। আমরাও দেখেছি। তারপর পুলিশ গিয়ে কিছু খুঁজে পায়নি। এরপরও কি আপনি বলবেন ব্যাপারটা ভৌতিক নয়?
কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে একটু হাসলেন। ভৌতিকই মনে হচ্ছে, তবে কালো রঙের নোটবইটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। আর এই উড়ো চিঠিটার ভাষা লক্ষ্য করেছ?
চিঠিতে কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। সাদামাঠা চিঠি।
ঠিক। কিন্তু–কর্নেল আবার চিঠিটা পড়লেন। পড়ার পর বললেন, নাহ্। ঠিক নয়। উনি জোরে মাথা নেড়ে বললেন ফের, চিঠিটার বৈশিষ্ট্য আছে। একেবারে মৌখিক ভাষার চালে লেখা। দেখ জয়ন্ত, লিখিত ভাষা এবং মৌখিক ভাষার মধ্যে তফাত আছে। সাধারণত আমরা যখন চিঠি লিখি, তখন কলমের ডগায় ভাষার শব্দচয়ন একরকম এবং মুখে কথা বলি যখন, তখন অন্যরকম। যাঁরা পেশাদার লোক তারাও এর ব্যতিক্রম নন। এই চিঠিটা যেন চিঠি নয়, মুখোমুখি কথা বলা। কর্নেল চোখ বুজে গুম হয়ে গেলেন। কামড়ানো চুরুটের নীল ধোঁয়া ওঁর টাকের ওপর দিয়ে পেঁচিয়ে উঠল এবং সাদা দাড়িতে এক টুকরো ছাই খসে পড়ল।…
০৩. শব্দক্রীড়া এবং অদ্ভুত প্রশ্ন
হরিচরণ গাঙ্গুলির বাসা একটা আঁকাবাঁকা গলির শেষপ্রান্তে। পিছনে একটা খাটাল এবং বস্তি এলাকা। বাড়িটা দোতলা। পাশে একটা ছোট্ট পুকুর। পুকুরে কচুরিপানা ভর্তি। বিকেলেই মশার প্রচণ্ড উৎপাত।
যে সময়ের কথা বলছি, তখনও এদিকটায় পোমোটারদের নজর পড়েনি। দোতলা বাড়িটার আশেপাশে অনেক একতলা বাড়ি। কোনওটা পুরনো, কোনওটা নতুন। এ বাড়িটা পুরনো। একতলায় একটা প্রেস, মুদির দোকান, পাউs বিস্কুটের দোকান কয়লার ডিপো এইসব।
টাইপিস্ট ভদ্রলোক নিচেই অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের দেখে শশব্যস্তে অভ্যর্থনা করে দোতলায় নিয়ে গেলেন। ঘরে সাধারণ আসবাব। টেবিলে একটা পোর্টবল টাইপরাইটার কভারে ঢাকা। অনেক কাগজপত্রও লক্ষ্য করলাম। বোঝা গেল, বাড়িতেও টাইপের কাজকর্ম করেন।
হরিবাবু বন্ধ জানালা দেখিয়ে বললেন, বড় মশা। তাই জানালা বন্ধ করে রাখি। এখনই কী উৎপাত দেখুন! এমন সাংঘাতিক মশা স্যার, বিষাক্ত ওষুধ স্প্রে করেও কাজ হয় না।
তিনি ঘরে আলো জ্বেলে দিলেন। কর্নেল ঘরের ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। বললেন, শ্যামবাবুর কোনও ফোটো নেই আপনার কাছে?
দেয়ালে কয়েকটা বাঁধানো ফোটো ঝুলছিল। হরিবাবু বললেন, না স্যার। ওগুলো আমার ফ্যামিলির ছবি। তবে ওই ছবিটা বরমডিহির মুনলেকের ধারে শচীনবাবুর ফ্যামিলির সঙ্গে তোলা আমার ছবি।
কর্নেল সেই ছবিটার কাছে গেলেন। দেখতে দেখতে বললেন, ভোলা নেই এর মধ্যে?
ওই লোকটা ভোলা স্যার!
রোগা বেঁটে এবং ফো একটা লোক একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কাঁচুমাচু হাসি। পরনে হাতকাটা ফতুয়া এবং খাটো ধুতি। পুরাতন ভৃত্যমার্কা চেহারা। আমরা ঝড়বৃষ্টির সন্ধ্যায় যে ভোলাকে দেখেছিলাম, সে শক্তসমর্থ গড়নের। সে এই ছবির ভোলা নয়। আর অ্যাডভোকেট ভদ্রলোকের তাগড়াই চেহারা। চেহারায় আভিজাত্য ঠিকরে বেরুচ্ছে, যদিও ছবিটা পুরনো। হরিবাবু তার পেছনে। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। প্রায় আট বছর আগে ভোলা গ্রুপ ফোটো। তবু হরিবাবুকে চেনা যাচ্ছে।