কর্নেল যেন কথা ঘুরিয়ে দিতেই বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরি।
হরিচরণ নমস্কার করলেন। আপনার কথাও আমাকে মহীবাবু বলেছে কর্নেলসায়েবের ঠিকানা উনিই আমাকে দিয়েছে। রিটায়ার্ড পুলিশ অফিস স্যার। লেকটাউনে থাকেন। তা আপনি কী যেন বললেন কথাটা?
কর্নেল দ্রুত বললেন, সে অন্য কেস। আপনি বলুন।
হরিচরণ বললেন, জয়ন্তবাবু বমডিহি বললেন। আমার কানে কথাটা ২৯ করে বিধল। মানে, আমি স্যার একসময় এক অ্যাডভোকেট ভদ্রলোকের কাষ ছিলাম। তার কিছু বিষয়সম্পত্তি ছিল বমডিহিতে। সেই নিয়ে ভাইয়ে-ভাইয়ে মামলা মোকদ্দমা। দুই ভাই-ই সমান গোঁয়ার। তাতে পরস্পর বৈমাত্রেয় ভাই।
এবার কর্নেলের চোখ উজ্জ্বল দেখাল। আস্তে বললেন, আপনি কি শচীন্দ্রলাল মুখার্জির ক্লার্ক ছিলেন?
হ্যাঁ স্যার! তবে সে অনেক বছর আগের কথা। উনি ওকালতি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। আর আমিও বেকার হয়ে গিয়েছিলাম। তো একটা কিছু না জোটালে বাঁচি কী করে? অগত্যা
টাইপিস্টের কাজ শুরু করেছিলেন?
হরিচরণ ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন। আপনি স্যার সত্যিই অন্তর্যামী। মহীবাবু যা-যা বলেছিলেন, মিলে যাচ্ছে। আপনি কেমন করে জানলেন আমি টাইপিস্টের কাজ করি?
আপনার আঙুল দেখে মনে হল আপনি টাইপিস্ট। কর্নেল হাসলেন। আর বরমডিহির সম্পত্তি নিয়ে ভাইয়ে-ভাইয়ে মামলার খবর কাগজে বেরিয়েছিল।
আমি স্যার আলিপুর কোর্ট চত্বরে টাইপরাইটার নিয়ে বসি। স্বাধীনভাবে কাজকর্ম করি। চলে যায় কোনওরকমে।
আপনার মামাতো ভাইয়ের ব্যাপারটা বলুন!
শ্যাম ছিল একের নম্বর বাউণ্ডুলে। মধ্যে মধ্যে আমার কাছে এসে থাকত। আবার কিছুদিনের জন্য কোথায় বেপাত্তা হয়ে যেত। তাই বছর সাত-আট আগে ও যখন উধাও হয়ে গিয়েছিল, গা করিনি। কিন্তু ইদানীং প্রায় ফি সপ্তায় একটা করে উড়োচিঠি আসতে শুরু করল। সব চিঠিতে লাল ডটপেনে লেখা, শ্যামসুন্দরের কালোরঙের নোটবইটা নিয়ে গঙ্গার ধারে আউট্রাম ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমরা চিনে নেব তোমাকে। ওটা পেলে শ্যামসুন্দর প্রাণে বাঁচবে।
হরিচরণ বিষণ্ণমুখে শ্বাস ছেড়ে চুপ করলে কর্নেল বললেন, তারপর?
মহীবাবুকে সঙ্গে নিয়ে অগত্যা লালবাজারে গিয়েছিলাম। শ্যামের কোনও জিনিসপত্র আমার ঘরে ছিল না। তো পুলিশ সাদা পোশাকে দিনকতক ফাঁদ পাতল। কিন্তু কেউ আমার কাছে এল না। আমি স্যার পুলিশের কথা মতো একটা কালো নোটবই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। যাই হোক, শেষে পুলিশ বলল, বোগাস! কেউ জোক করছে। আর তারপর থেকে পুলিশ আমাকে পাত্তা দিল না। কিন্তু তারপর এই চিঠিটা গতকাল ডাকে এসেছে দেখুন!
উনি একটা খাম দিলেন কর্নেলকে। কর্নেল আগে খামের টিকিটে ডাকঘরের ছাপটা আতস কাচ দিয়ে দেখে নিলেন। তারপর চিঠিটা বের করলেন। তার কাঁধের পাশ দিয়ে উঁকি দিলাম। সাদা কাগজে লালকালিতে লেখা আছে
ঘুঘু ধরতে ফাঁদ পেতেছিলে। এ বড় সেয়ানা ঘুঘু। তোমার বদমাইসির জন্য শ্যামকে খতম করে পুঁতে ফেলেছি। এবার তোমার পালা। আগামী ৭ ডিসেম্বরে মধ্যে শ্যামের কালো নোটবইটা না পেলে এবার তুমি খতম হয়ে শ্যামের মতোই মাটির তলায় চলে যাবে। এবার পুলিশকে জানালে ওটা পাই বা না পাই, তোমার নিস্তার নেই। কাজেই সাবধান। কোর্ট চত্বরে কোনও একদিন কোনও এক সময়ে কেউ তোমার কাছে টাইপ করাতে গিয়ে বলবে এন বি। তুমি তক্ষুণি তার হাতে ওটা দেবে। আর তাকে ধরে চ্যাঁচামেচি করলে হাটে ড্যাগার ঢুকে যাবে। বুঝলে বুদ্ধিমান? কেন ঝামেলা করছ? করবেই বা কেন?
কর্নেল চিঠিটা পড়ে বললেন, আজ দোসরা ডিসেম্বর।
হরিচরণ ব্যাকুলভাবে বললেন, আমি স্যার কোনও কালো নোটবই পাইনি। খামোক আমার ঘাড়ে এ কী বিপদ এসে পড়েছে দেখুন। আপনি আমাকে বাঁচান স্যার!
কর্নেল চুরুট ধরালেন। আমি বললাম, লোকটাকে ধরে ফেলতে অসুবিধে কী?
হরিচরণ বললেন, ধরে না হয় ফেললেন। কিন্তু তারপর? তারপর আমার লাইফরিস্ক কি না বলুন? সারাক্ষণ তো কেউ আমার বডিগার্ড হয়ে থাকতে পারে না! তার চেয়ে বড় কথা, শ্যামের তেমন কোনও নোটবই সত্যি আমি খুঁজে পাইনি–বিশ্বাস করুন!
কর্নেল চিঠিটা আতস কাঁচে পরীক্ষা করছিলেন। বললেন, আগের চিঠিগুলো কি আপনি পুলিশকে দিয়েছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। নৈলে কিসের বেসিসে পুলিশের সাহায্য চাইব?
কর্নেল কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানার পর বললেন, পাইকপাড়ায় আপনার নিজের বাড়ি, নাকি ভাড়াবাড়িতে থাকেন?
ভাড়া বাড়ি। একখানা মোটে ঘর। আমার ফ্যামিলি থাকে মেদিনীপুরের গ্রামে।
আপনি কত বছর শচীন্দ্রবাবুর ক্লার্কের কাজ করেছেন?
তা বছর দশেকের বেশি হবে।
বিরমডিহিতে কখনও গেছেন?
একবার গেছি। হরিচরণ স্মরণ করার ভঙ্গিতে বললেন,–বছর আষ্টেক আগে। শচীনবাবুর ফ্যামিলির সঙ্গে গিয়েছিলাম। খুব সুন্দর জায়গা স্যার! সিনসিনারি অপূর্ব! একটা লেক আছে পাহাড়ের মাথায়। আধখানা চাঁদের মতো দেখতে। তাই মুন লেক নাম।
ভোলাকে চিনতেন নিশ্চয়?
হরিচরণ মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ। খুব চিনতাম। পরে ভোলাকে শচীনবাস বরমডিহির বাড়ির কেয়ারটেকার করেছিলেন। সে সেখানেই থাকত। অসুখবিসুখে মারা যায়। বলে টাইপিস্ট ভদ্রলোক একটু গম্ভীর হলেন। এক ওই বাড়িটা স্যার ভাল নয়।