হুঁ। বলে কর্নেল কফিতে চুমুক দিলেন।
পুলিশ কী বলল?
সন্ধ্যানীড় নাকি একটা পোড়ো বাড়ি। বাড়িটা নিয়ে অ্যাডভোকেট শচীন্দ্রলাল মুখার্জি এবং তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই তরুণকুমার মুখার্জির মধ্যে বহু বছর ধরে মামলা চলছে। তাই বাড়িটার ওই অবস্থা। ওঁরা কলকাতায় থাকেন। অসুখে ভুগে কেয়ারটেকার কবে মারা গেছে। তার নাম ভোলা ছিল কি না পুলিশ জানে না।
তাহলে ঘটনাটা রহস্যময়। বরং বলা চলে রহস্যময় হত্যাকাণ্ড।
হ্যাঁ। তবে আমরা হঠাৎ ওখানে গিয়ে পড়ায় হত্যাকারীরা একটা নাটকীয় দৃশ্য তৈরি করেছিল।
ঠিক বলেছেন। সেই ভোলা ব্যাটালের চেহারা মনে পড়ছে। কেমন ষণ্ডামার্কা।
লোকটা কিন্তু বাঙালি।
আমরা কিছুক্ষণ এইসব আলোচনা চালিয়ে গেলাম। তারপর কর্নেল সেই পলাতক প্রজাপতিটি নিয়ে হাহুতাশ শুরু করলেন। প্রজাতির লাতিন নাম দোরাতিস আপোলিনাস। এই প্রজাতির প্রজাপতি এই অঞ্চলে আবিষ্কার করে সত্যিই আমি বিস্মিত হয়েছি জয়ন্ত! এরা মধ্যএশিয়া–বিশেষ করে তুর্কিভাষী এলাকার বাসিন্দা। সম্ভবত মধ্যযুগে কোনও প্রজাপতিপ্রিয় তুর্কি সুলতান এ ওদের এনে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কলকাতা ফিরে বইপত্তর ঘাঁটতে হবে।
আমার মাথায় সন্ধ্যানীড়ের হত্যাকাণ্ড। রক্তারক্তি অবস্থা। প্রকৃতিবিদের বকবক কানে নিচ্ছিলাম না। বেশ কিছুক্ষণ পরে রামভরসা এসে কর্নেলকে সেলাম দিল। স্যার! আপনার টেলিফোন!
কর্নেল হন্তদন্ত নিচে চলে গেলেন।
যখন ফিরলেন, তখন মুখ একেবারে গম্ভীর। ধপাস করে বসে চোখ বুজে টাকে হাত বুলোতে শুরু করলেন। জিজ্ঞেস করলাম, কার ফোন?
কর্নেল চোখ বুজে টাকে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, পুলিশ সন্ধ্যানীড়ে জিপ নিয়ে গিয়েছিল। তন্নতন্ন খুঁজে কোনও ডেডবডি পায়নি। ওপরের ঘরের মেঝেয় এবং নীচের ঘরের টেবিলে এক ফোঁটা রক্তও নেই। সিলিঙের সেই টালিটা অবশ্য ভাঙা দেখেছে। পুলিশের মতে সেটা স্বাভাবিক। পুলিশ অকারণ হয়রানির জন্য আমাকে হুমকি দিল।
রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠলাম, কর্নেল! আমরা পোড়োবাড়িতে নির্ঘাত ভূতের পাল্লায় পড়েছিলাম!…
০২. কালো নোট বই
বরমডিহি থেকে কলকাতা ফেরার পর কিছুদিন সেই ঘটনাটা নিয়ে অনেক থিওরি খাড়া করেছিলাম। কিন্তু কোনওটাই যুক্তি দিয়ে দাঁড় করাতে পারছিলাম না। আর কর্নেলকেও তা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে দেখিনি। তিনি প্রজাপতি সংক্রান্ত বইয়ে মগ্ন ছিলেন। কখনও দেখতাম তুর্কিভাষী সুলতানদের ইতিহাসের বইও ঘাঁটছেন।
আমি দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক। অফিসে অজস্র খবরের কাগজ আসে। খুঁটিয়ে পড়ি, যদি বরমডিহিতে কোনও খুনখারাপির কিংবা কারও নিরুদ্দেশের খবর চোখে পড়ে। কিন্তু তেমন কোনও খবর চোখে পড়ে না। দেখতে দেখতে শীত এসে গেল। ঘটনাটা গভীরভাবে তবু মনে গাঁথা রইল। দুঃস্বপ্ন দেখতাম কত রাত্রে। অবশেষে কর্নেলকে একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, অ্যাডভোকেট শচীন্দ্রলাল মুখার্জি বা তাঁর বৈমাত্রেয় ভাইয়ের কলকাতার ঠিকানা যোগাড় করা উচিত ছিল। করেননি কেন?
কর্নেল বললেন, করেছি। ওঁরা বহাল তবিয়তে আছেন এবং মামলা এখন সুপ্রিমকোর্টে উঠেছে। শচীন্দ্রবাবু এখন আর প্র্যাকটিস করেন না। তরুণবাবু ব্যবসাবাণিজ্য করেন। তিনি মিটমাটের পক্ষপাতী। কিন্তু শচীন্দ্রবাবু ভীষণ একগুঁয়ে মানুষ। কারণ তার বক্তব্য, তার বাবা মহেন্দ্রলাল ন্যায্য উইল করে তাকে বরমডিহির বাড়িটা দিয়ে গেছেন। তরুণবাবুর বক্তব্য, উইলটা জাল। এতেই শচীন্দ্র বৈমাত্রেয় ভাইয়ের ওপর খুবই ক্ষুব্ধ।
আপনি কি খুনের ঘটনাটা ওঁদের বলেছেন?
বলেছি। দুজনেরই মতে, ওই এলাকায় খুনখারাপি আকছার হয়। বাড়িটা পোডড়া হয়ে গেছে। কাজেই সেখানে যে যা খুশি করতেই পারে। আর সত্যিই ভোলা নামে শচীন্দ্রবাবুর একজন চাকর ছিল। সে বেঁচে নেই।
কিন্তু প্রায় দু মাস হয়ে গেল। কোনও কাগজে বরমডিহির কোনও—
কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, আজকাল সব খবর কাগজে বেরোয়। কাগজের লোক হয়ে এ তোমার জানার কথা। তার চেয়ে বড় কথা, পুলিশ আমার নাম ঠিকানা নিয়েছিল। তেমন কিছু ঘটলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করত।
তাহলে তো ব্যাপারটা সত্যিই ভুতুড়ে বলতে হয়।
এই সময় ডোরবেল বাজল। কর্নেলের ভৃত্য ষষ্ঠীচরণ এসে বলল, এক ভদ্রলোক এয়েছেন বাবামাশাই! বলছেন, খুব বিপদে পড়ে আপনার সাহায্য নিতে এয়েছেন। বললাম, বাবামশাই ব্যস্ত। উনি বললেন–
চোখ কটমটিয়ে কর্নেল বললেন, ডেকে নিয়ে আয়।…
একটু পরে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে কর্নেলকে নমস্কার করে করুণ হাসলেন, আপনাকে ডিসটার্ব করার জন্য দুখিত। কিন্তু আমার উপায় ছিল না। এতদিন ধরে পুলিশ কোনও কিনারা করতে পারল না। অগত্যা আপনার শরণাপন্ন হলাম।
আপনি বসুন।
ভদ্রলোকের পরনে সাধারণ প্যান্ট-শার্ট। কাঁধে একটা কাপড়ের নকশাদার ব্যাগ। কিন্তু ব্যাগটা পুরনো। তার চেহারা রোগা এবং ঢ্যাঙা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফ। সোফার কোনায় তিনি আড়ষ্টভাবে বসে বললেন, আমার নাম হরিচরণ গাঙ্গুলি। থাকি পাইকপাড়ায়। মাস দুয়েক আগে আমার মামাতো ভাই শ্যামসুন্দর হঠাৎ নিখোঁজ। তারপর
আমি বলে উঠলাম, বরমডিহি এবং তখনই কর্নেল চোখ কটমট করে আমাকে থামিয়ে দিলেন।
হরিচরণবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী বললেন যেন?