কর্নেলের সঙ্গে সেই ঘরে ঢুকলাম। দেখলাম, একটা তক্তাপোসে নোংরা। বিছানায় একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। তার গায়ে নোংরা ছেঁড়া একটা চাঁদর চাপানো। ঘরের ভেতর আর কোনও আসবাব নেই। দেয়ালের তাকে অনেকগুলো শিশিবোতল কৌটো এইসব জিনিস। ভোলার লণ্ঠনটার অবস্থাও শোচনীয়। লণ্ঠনটা যেন অতিকষ্টে সামান্য একটু আলো ওগরাচ্ছে।
কর্নেল বললেন, তোমার কর্তামশাইয়ের চিকিৎসা করছেন কে?
আজ্ঞে বরমডিহি সরকারি হাসপাতালের এক ডাক্তার।
অসুখটা কি?
ধরা যাচ্ছে না। কর্তামশাইয়ের তেমন টাকাকড়িও নেই যে ভাল ডাক্তার দেখাবেন!
ওঁর কোনও আত্মীয়স্বজন নেই?
কলকাতায় আছে। এনার ছোট ভাই। কিন্তু দাদার সঙ্গে বনিবনা নেই।
এই সময় হঠাৎ কোথায় একটা চাপা শব্দ এবং আবছা গোঙানি শোনা গেল। কর্নেল এবং আমি দুজনেই চমকে উঠেছিলাম। কর্নেল বললেন, ও কিসের শব্দ?
ভোলা গম্ভীর মুখে বলল, আজ্ঞে, ভয় পাবেন না। এ বাড়িতে এরকম অনেক শব্দ হয়।
বলো কী!
হ্যাঁ স্যার। প্রথম প্রথম আমি ভয় পেতাম। আর গেরাজ্জি করি না।
তুমি কি ভূতপ্রেতের কথা বলছ?
ভোলা গলার ভেতর বলল, রাতবিরেতে ওসব কথা থাক স্যার! আপনি নীচে গিয়ে বসুন। বিষ্টি কমে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।
কর্নেল টর্চ জ্বেলে অসুস্থ আইনজীবীকে দেখতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভো তক্ষুনি আলোর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আলো ফেলবেন না স্যার! এক্ষুনি চো আলো লাগলে হুলুস্থুল বাধাকেন। সামলাতে পারব না। দয়া করে আপনারা নি গয়ে বসুন। বিষ্টি ছাড়লে চলে যাবেন।
কর্নেলের সঙ্গে নিচের সেই ঘরে যখন ফিরে গেলাম, তখন আমি আতঙ্কে প্রায় হতবুদ্ধি। বললাম, কর্নেল! বৃষ্টি কমেছে। চলুন, কেটে পড়ি। এ বাড়ির হালচাল গোলমেলে মনে হচ্ছে।
কর্নেল একটা চেয়ারে বসে বললেন, আর মিনিট পনের অপেক্ষা করা যাক। প্রায় এক কিলোমিটার আমাদের হাঁটতে হবে।পথে কোনও যানবাহনের আশা নেই। বসো?
বসলাম চেয়ার টেনে। কিন্তু চেয়ারটা এবার কেমন বিচ্ছিরি শব্দ করল। কর্নেল টর্চের আলোয় ঘড়ি দেখে বললেন, মোটে সাড়ে ছটা। অক্টোবরে সাড়ে ছটা মানে অবশ্য সন্ধ্যা। কিন্তু এখানে আবহাওয়ার দরুন মনে হচ্ছে নিশুতি রাত।
একটু পরে টুপ টুপ করে শব্দ হতে থাকল। শব্দটা টেবিলের ওপর। বললাম, কর্নেল! দোতলার ছাদের নিশ্চয় ফাটাফুটি অবস্থা। সেই জল চুঁইয়ে নিচের ঘরে পড়ছে।
কর্নেল টর্চ জ্বাললেন টেবিলের ওপর। অমনি আতঙ্কে গলা শুকিয়ে গেল। ছাদ থেকে চুঁইয়ে টুপ টুপ করে টেবিলে যা পড়ছে তা জল নয়। গাঢ় লাল রক্ত।
হ্যাঁ, তাজা রক্ত। কর্নেলের টর্চের আলো ছাদে পৌঁছুল। টালির ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে রক্তবিন্দু। টেবিলে থকথক করছে রক্ত। থরথর করে কেঁপে উঠলাম। অজানা ত্রাসে। এ এক বিভীষিকা। কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বললেন, এস তো দেখি!
আবার সিঁড়ি বেয়ে দুরুদুরু বুকে ওপরে গেলাম। কর্নেল ডাকলেন, ভোলা! ভোলা! কিন্তু কোনও সাড়া এল না।
সেই ঘরের দরজায় গিয়ে কর্নেল টর্চ জ্বাললেন। দরজা খোলা এবং ভেতরের তত্তাপোসে নোংরা বিছানায় কেউ নেই। বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলাম। কর্নেল সেই ঘরের ভেতর ঢুকে বললেন, আমরা যে ঘরে ছিলাম, সেটা ওই পারে ঘরের নিচে। বলে পাশের ঘরের দরজা ঠেললেন।
ভেজানো দরজা খুলে গেল। তারপর কর্নেলের টর্চের আলোয় দেখলাম, একটা লোক রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেয় পড়ে আছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য! দেখা মাত্র চোখ বন্ধ করলাম। এ নিশ্চয় কোনও ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখছি!
কর্নেল দেখে নিয়েই বললেন, কুইক জয়ন্ত! ভিজতে ভিজতেই বাংলোয় ফিরতে হবে। তারপর ব্যস্তভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
কাঁপতে কাঁপতে বললাম, অ্যাডভোকেট ভদ্রলোককে ভোলা মার্ডার করেছে!
না। একজন মধ্যবয়সী লোককে জবাই করা হয়েছে।
আর কোনও কথা বলার মতো মনের অবস্থা ছিল না। বৃষ্টি কমেছে কিন্তু তখনও ক্রমাগত বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছিল। রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, জায়গাটা চিনতে পারছি। এটাকে একসময় বলা হত বাঙালিটোলা। বাড়িগুলো একটা করে বাগানবাড়ির মতো। দূরে-দূরে ছড়ানো। আজকাল এসব বাড়ির মালিকেরা কলকাতায় চলে গেছেন। কেয়ারটেকার থাকে। বাঙালিরা বেড়াতে এলে এগুলো কেয়ারটেকারই ভাড়া দেয়। কিন্তু ওই সন্ধ্যানীড় নামে বাড়িটা–
কর্নেল হঠাৎ চুপ করলেন। হন্তদন্ত হাঁটতে থাকলেন।
ডাকবাংলোয় পৌঁছুলে আমাদের দেখে চৌকিদার রামভরসা হিন্দিতে বলল, হায় রাম! আপনারা ঠিকই কালা দেওয়ের পাল্লায় পড়েছিলেন। তবে রামজির কৃপায় যে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পেরেছেন, এই যথেষ্ট।
জলদি কফি! বলে কর্নেল বাথরুমে ঢুকলেন পোশাক বদলাতে। একটু পরে বেরিয়ে এসে বললেন, আমি আসছি। তুমি পোশাক বদলে ফেলো ডার্লিং!
কোথায় যাচ্ছেন?
কেয়ারটেকারের অফিসে টেলিফোন আছে। এখনই থানায় ব্যাপারটা জানানো দরকার।
আমার মাথা এবং প্যান্টশার্ট কাদায় মাখামাখি। বাথরুমে ঢুকে ঝটপট স্নান করে নিলাম। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ব্যালকনিতে বেতের চেয়ারে বসলাম। এতক্ষণে শরীর-মন তাজা। সেই হানাবাড়ির দৃশ্যগুলি খুঁটিয়ে স্মরণ করছিলাম। যা দেখেছি, তার কোনও মাথামুণ্ডু খুঁজে পাওয়া যায় না।
এতক্ষণে কর্নেল ফিরলেন। রামভরসা কফির ট্রে রেখে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, থানায় কি জানিয়ে দিলেন ব্যাপারটা?