একটু পরে বললাম, হরিচরণের ঘরে শ্যামসুন্দরের কালো নোটবই পাওয়ার রহস্য ফাস হল তা হলে। কিন্তু কর্নেল, হরিচরণ আপনার শরণাপন্ন হল কেন, সন্ধ্যানীড়ে আপনার পেটেন্ট সান্তা ক্লজ মার্কা চেহারা হারাধন এবং তার দেখা।
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, দুটো কারণে। একটা কারণের কথা আগেই বললাম। সাংকেতিক সূত্র কৌশলে জেনে নেওয়া। কিংবা ভেবেছিল, আমিই ওকে সেই সূত্রর সাহায্যে বিগ্রহ উদ্ধার করে দেব। তবে এটা গৌণ কারণ। মুখ্য। কারণ হল ওর জডুল। তার নাকের পাশে জডুল নেই, এটা দেখাতে গিয়েছিল। অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি।
তার মানে, সে আপনার সবিশেষ পরিচয় ২৫ অক্টোবরের আগে থেকেই জানত?
নাহ। সে জনত না। পরে জেনেছিল। আমি শচীনবাবুর বাড়িতে প্রথম যাওয়ার পরই সে জানতে পারে আমি কে। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় প্ল্যান করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়েছিল। কিন্তু যেদিন আমি তাকে জডুলের কথা জিজ্ঞেস করলাম, সেদিনই সে গা ঢাকা দিল এবং বরমডিহিতে চলে এল। তাকে সন্ধ্যানীড়ের ৮ নম্বর ঘরের মেঝেয় বিগ্রহ পুঁতে রাখার মিথ্যা সূত্র দিয়েছিলাম। তাই গা ঢাকা দিয়ে সে বিগ্রহ উদ্ধারের ফিকির করেছিল। জয়ন্ত! রেলস্টেশনে তরুণবাবুকে এই হরিচরণ দেখা করেছিল। ক্লিয়ার?
ক্লিয়ার। তবে এখনও কিছু–
বাকিটা কলকাতায় ক্লিয়ার হবে।
.
আমরা সেদিনই দুপুরের বাসে আসানসোল এবং সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা ফিরেছিলাম। কর্নেল বলেছিলেন, সময়মতো আমাকে ডাক দেবেন। সেই ডাক পেলাম দুদিন পরে সকালবেলায়।
কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখি, তরুণ মুখার্জি বসে আছেন। বেশ হাসিখুশি মুখ।
কর্নেল বললেন, তরুণবাবুর বেনামী চিঠিতে কাজ হয়েছে, জয়ন্ত! শচীনবাবু আমাকে ডেকেছে। এখন আমার ভূমিকা মিলম্যানের। দেখা যাক। সাড়ে দশটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এখন দশটা বাজে। বেরুতে হবে।
তরুণবাবু বললেন, জয়ন্তবাবু! হরি এবং আমার অফিসের বজ্জাত বেয়ারা অবাধন বরমডিহি রেলস্টেশনেই ধরা পড়েছে।
বললাম, সুখবর! কিন্তু মিঃ মুখার্জি, একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। হারাধন তো ২৫ অক্টোবর হিলটপ বাংলোয় আপনার কাছে ছিল। সে কী করে—
শুনুন। শ্যামসুন্দরকে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়ানোর কিছুক্ষণ পর হারাধন বাংলো থেকে বেরিয়ে যায়। ফিরেছিল রাত নটা-সাড়ে নটা নাগাদ। ফিরে বলল, ঝড়বৃষ্টিতে বাজারে আটকে গিয়েছিল। যাই হোক, হারাধন আমাদের গৃহদেবতা চুরি হওয়ার কথা জানত। আমার অফিসের সবাই জানে সে কথা। কিন্তু হারাধন যে সাংঘাতিক লোক, কেমন করে জানব? হরির সঙ্গে সে, কিংবা হরি তার সঙ্গে যোগাযোগ করে দল বেঁধেছিল আর কী! পুলিশ জেরা করে কথা আদায় করবে। তবে আমার ধারণা, সে শ্যামসুন্দরের পিছু নিয়েছিল। তারপর শ্যামসুন্দরকে সে হরির কাছে নিয়ে যায়। নিশ্চয় একটা প্ল্যান ছিল। বলে ঘড়ি দেখে তিনি বললেন, চলুন। আপনাদের দাদার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দেব।…
ভবানীপুরে আমাদের নামিয়ে দিয়ে তরুণবাবু চলে গেলেন। আমরা প্রাক্তন আইনজীবী শচীনবাবুর বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকলাম।
শনিবাবু ব্যস্তভাবে অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের অভ্যর্থনা করে বসতে বললেন তার মুখে উদ্বেগের ছাপ। পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে কর্নেলকে দিলেন। বললেন, আমার দৃঢ় ধারণা, এটা তরুণেরই একটা ফাঁদ।
কর্নেল চিঠিটা পড়ে গম্ভীর মুখে বললেন, কিন্তু আপনি বিপন্ন মিঃ মুখার্জি।
শচীনবাবু চমকে উঠে বললেন, বিপন্ন?
হ্যাঁ। শ্যামসুন্দরের লাশ আপনার সন্ধ্যানীড়ের ইদারার তলায় পুলিস আবিষ্কার করেছে। হরিবাবুকে অ্যারেস্ট করেছে। হরিবাবু কবুল করেছেন, খুনের রাত্রে আপনিও বরমডিহিতে ছিলেন। এমন কি সন্ধ্যানীড়েই লুকিয়ে ছিলেন।
শচীনবাবু ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, ছিলাম। হরি বলেছিল, শ্যামা বিগ্রহ ফেরত দিতে চেয়েছে। তার বদলে ওকে দশহাজার টাকা দিতে হবে। বিকেলে পাঁচটা নাগাদ শ্যামা নাকি বিগ্রহ নিয়ে আসবে। শচীনবাবু বিকৃত মুখে ফের বললেন, কিন্তু হরি ব্যাটাচ্ছেলে তার এক স্যাঙাতকে নিয়ে যে শ্যামাকে খুন করে ফেলবে, তা কি আমি জানতাম? দোতলার একটা ঘরে অপেক্ষা করছি। ওরা শ্যামাকে পাশের ঘরে নিয়ে ঢুকেছে। তারপর হঠাৎ ঝড়বৃষ্টি এসে গেল। আমি তো চুপচাপ বসে ইষ্ট নাম জপ করছি। কতক্ষণ পরে ঝড় থামল, বৃষ্টি থামতে চায় না। হঠাৎ পাশের ঘরে ঝগড়া বেধে গেল। তারপর আর্তনাদ শুনতে পেলাম। আমি উঁকি মেরে টর্চ জ্বেলে দেখি, ওঃ! হরির স্যাঙাত শ্যামার বুকে বসে তার গলায়–ওঃ! কী সাংঘাতিক দৃশ্য! আমি ভয় পেয়ে দিশেহারা হয়ে নেমে গেলাম। উঠোনে ইদারার পাশে খিড়কির দরজা খুলে পালানোর চেষ্টা করছি। সেই সময় বাইরে হাঁকডাক। আপনারা এসে দরজায় ধাক দিচ্ছিলেন। যাই হোক, অনেক কষ্টে দরজার হুড়কো খুলে বেরুলাম। আমার এক ধনী মক্কেলের বাড়িতে উঠেছিলাম। তো অনেক রাত্রে হরি গিয়ে বলল বাধ্য হয়ে শ্যামাকে খুন করেছে। তার বডি এমন জায়গায় লুকিয়েছে, কেউ খুঁজে পাবে না। তারপর আপনাদের কথা বলল। আপনার চেহারার বর্ণনা দিয়ে বলল, এক দাড়িওয়ালা সায়েবের মতো চেহারার ভদ্রলোককে বোকা বানিয়েছে। সকালে আপনাকে আমার মক্কেলের বাড়ির দোতলা থেকে দেখলাম, বাইনোলাকে কী দেখছেন। মক্কেলের নাম অরিজিৎ সিংহ। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ভদ্রলোককে চেনে কি না। অর্থাৎ লোকাল লোক, না টুরিস্ট? অরিজিৎ বলল ওরে বাবা! উনি তো বিখ্যাত লোক। আপনার সবিশেষ পরিচয় পেলাম।