বলে কর্নেল তার স্যুটকেস খুলে সাদা পলিথিন পেপারে মোড়া বিগ্রহ বের করলেন। মোড়ক খুলতেই কষ্টিপাথরের তৈরি রাধাকৃষ্ণের প্রাচীন বিগ্রহ বেরিয়ে পড়ল। তরুণবাবু গৃহদেবতাকে দুহাতে তুলে মাথায় ঠেকিয়ে তারপর টেবিলে রাখলেন। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, অক্টোবর মাসে শ্যাম টেলিফোনে আমার সঙ্গে এখানে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিল। এত বছর গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর হঠাৎ তার ফোন এবং হারানো গৃহদেবতা উদ্ধারের গল্প! স্বাভাবিকভাবে আমি আগ্রহ দেখিয়েছিলাম। কিন্তু সে এসে এক লক্ষ টাকা ক্যাশ দাবি করল। তার স্পর্ধা দেখে রাগ হয়েছিল। উপরন্তু সে হুমকি দিতে শুরু করল। দাদাকে সে জানিয়ে দেবে আমিই বিগ্রহ চুরি করেছিলাম তাকে দিয়ে। সেই বিগ্রহ কোথায় আমি লুকিয়ে রেখেছি, তা-ও নাকি জানিয়ে দেবে। দাদা নাকি বরমডিহিতে এসেছেন এবং এক বন্ধুর বাড়িতে আছে। বুঝুন তাহলে! আমার মনে হল এটা ব্ল্যাকমেল করার শামিল। আমি ওকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, শ্যামসুন্দর এর পর আপনার দাদার কাছে গিয়ে ফাঁদে পড়েছিল। সেদিন ২৫ অক্টোবর। তবে এটা ঠিক, শচীনবাবু খুনখারাপি চাননি। ওঁর অত্যুৎসাহী সাঙ্গোপাঙ্গ ওকে খুন করে ওর পকেট হাতড়ে কালো একটা নোটবই পেয়েছিল মাত্র। যাই হোক, রাত হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়া যাক। আপনি কি এখানে থাকবেন, নাকি বন্ধুর বাড়ি ফিরে যাবেন?
তরুণবাবু বললেন, নাহ্। আমি ব্রতীনের কাছে বিদায় নিয়ে এসেছি। গাড়িটা নিতে সকালে ওর ড্রাইভার আসবে।…
১০. নাটকের তৃতীয় চরিত্র
ঘুম ভেঙেছিল কর্নেলের ডাকে। তখন প্রায় দশটা বাজে। উনি অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণ থেকে ফিরেছিলেন। বাইরে রোদ্দুর ঝলমল করছে। তবে দুরে ইতস্তত ঘন কুয়াশা। বারান্দায় বসে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে বললেন, তরুণবাবু ওঁর ব্রাঞ্চ অফিসের জিপ নিয়ে কলকাতা রওনা হয়ে গেছেন।
বললাম, বিগ্রহ ওঁকে দিয়েছেন নাকি?
কেন দেব না? ওঁদেরই পূর্বপুরুষের ঐতিহাসিক বিগ্রহ।
আমার আর এখানে থাকতে একেবারে ইচ্ছে করছে না!
কর্নেল হাসলেন। পায়ের ব্যথা কমেছে?
নাহ।
তোমাকে নিয়ে গিয়ে দেখাতাম সন্ধ্যানীড়ের কোন ঘরে বন্দী ছিলে।
দেখতে চাইনে।
আমি দেখে এসেছি। দুটো দড়ি, একটা রুমাল এবং একটুকরো টেপ ওই ঘরে পড়ে ছিল। কুড়িয়ে এনেছি। স্যুভেনির ডার্লিং! যত্ন করে সাজিয়ে রেখো।
আপনি রাখবেন।
দুটো ছেঁড়া মুখোশ উঠোনের জঙ্গলে কুড়িয়ে পেয়েছি। ইঁদারায়—
আপনি তো আমার মুখে কিছু শোনেননি এখনও।
বুঝতে পেরেছি। শুনবখন। তো যা বলছিলাম। ইদারায় উঁকি মেরে দেখলাম পাথরে ভর্তি। কেমন একটা বিচ্ছিরি গন্ধ।
শ্যামসুন্দরের লাশ উঁদারার তলায় আছে। ওরা বলাবলি করছিল।
পুলিশকে জানিয়ে এসেছি। পুলিশ ইদারা থেকে শ্যামসুন্দরের কঙ্কাল উদ্ধার করতে ব্যস্ত। কর্নেল ডিমের পোচ চেটেপুটে খেয়ে ফের বললেন, তুমি যে ঘরে ছিলে, তার পাশের একটা ঘরের মেঝে খোঁড়া হয়েছে দেখলাম। এল প্যাটার্নের বাড়ি। সামনে দাঁড়িয়ে ডানদিক থেকে গুনলে ওটা ৮ নম্বর ঘর। আবার বাড়ির ভেতর উঠোনে দাঁড়িয়ে ডান দিক থেকে গুনলে যেটা ৮ নম্বর ঘর, সেটারও মেঝে খোঁড়া দেখতে পেলাম।
এক পলকের জন্য কথাটা মাথার ভেতর ঝিলিক দিয়েছিল। বললাম, ৮ নম্বর ঘর! মাই গুডনেস! কর্নেল, আপনি হরিবাবুকে বলেছিলেন না ৮ নম্বর ঘরের মেঝেয় বিগ্রহ পোঁতা আছে?
কর্নেল এবার আস্তে সুস্থে কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, । হরিচরণ গাঙ্গুলি। কাল তার এবং হারাধনের তোমাকে মড়ার মতো কাঁধে বইতে একটু কষ্ট হয়ে থাকবে। আহা বেচারারা খামোকা কষ্ট করল। বিগ্রহ যদি বা হাতাল, তা-ও নকল!
উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু হরিচরণকে তো অন্য কোন পার্টি শ্যামসুন্দরের কালো নোটবই ফেরত চেয়েছিল।
ওটা হরিচরণের চালাকি। আলিপুর কোর্টচত্বরে সেই ছেলেটি আমাকে বলেছে, হরিচরণই তাকে দিয়ে একটা মাত্র চিঠি লিখিয়েছিল। হরিচরণের মুখে শোনা মহীবাবু নামে কোন রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার এবং আউট্রাম ঘাটে সাদা পোশাকের পুলিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ঘটনা স্রেফ গুল। মহীবাবু নামটাও তার বানানো। আসলে ২৫ অক্টোবর ঝড়বৃষ্টির সময় হারাধন এবং সে শ্যামসুন্দরকে ফঁদে ফেলে খুন করে তার পোশাক খুঁজে বিগ্রহের সূত্র পেতে চেয়েছিল। কালো নোটবইটা পেয়ে যায় শ্যামসুন্দরের পকেটে। সাংকেতিক ছকটা নিয়ে মাথা ঘামায়। তারপর আমার শরণাপন্ন হয়। বাকিটা কলকাতা ফিরে বুঝবে। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হরিচরণের নাকে বাঁ পাশে বেঢপ গড়নের জডুল। সে যখন সন্ধ্যানীড়ের দোতলায় একটা ঘরে পাশ ফিরে চাঁদর মুড়ি দিয়ে এম. এল. মুখার্জি সেজে শুয়ে ছিল, তখন জডুলটা আমি দেখে ফেলেছিলাম। তাই কলকাতা ফিরে সে মরিয়া হয়ে জডুলটা অপারেশন করিয়েছিল।
কিন্তু বিদ্যুতের ছটায় উঠোনে আর একজনকে আমি দেখেছিলাম।
তাকে কলকাতা ফিরে আবার দেখাব। কফি শেষ করে কর্নেল চুরুট ধরালেন। বললেন, হরিচরণ এবং হারাধনের ফোটো পুলিশকে দিয়েছি। তার কোনওনা-কোনও সময় ধরা পড়বে। তরুণবাবুরও এখানে প্রভাব আছে। পলি শ্যামসুন্দরের কঙ্কাল পেলেই এবার অ্যাকশন নোবে। কারুর বিরুদ্ধে এতে অভিযোগ করতে গেলে কেউ যে সত্যিই খুন হয়েছে, তা দেখানো দরকা কাজেই অক্টোবরে যে অভিযোগ করতে আইনগত বাধা ছিল, এখন আর নেই।