শুনবখন। আগে তুমি ব্যাকগ্রাউন্ডটা শুনে না। কাল দুপুরে তো তরুণবাবুর সঙ্গে আমার বরমডিহি আসার কথা হয়ে গেছে। বিকেলে সেই লোকটা ট্রাঙ্ককল করে তরুণবাবুকে জানায়, বিগ্রহ উদ্ধারের কাজ চলছে। তরুণবাবু যেন বরমডিহি চলে আসেন। সে তার সঙ্গে এখানে যোগাযোগ রাখবে। কিন্তু তরুণবাবু হিলটপে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন। তাই তাকে বলেন, তিনি বরমডিহি যেতি রাজি। রাতের ট্রেনেই যাবেন। তবে হিলটপে যোগাযোগ করার ঝুঁকি আছে। দৈবাৎ তার দাদা শচীনবাবুর কোনও বন্ধুর চোখে পড়ে গেলে ঝামেলা হবে। তার চেয়ে বরং তাঁর সঙ্গে সে যেন রেল স্টেশনেই যোগাযোগ করে। লোকটা বলে, তার পরনে থাকবে নীলচে সোয়েটার। মাথায় মাংকিক্যাপ। চোখে সানগ্লাস। মুখে দাড়ি। কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে ফের বললেন, দুপুরে তরুণবাবুর কাছে গিয়ে শুনলাম দেখা হয়েছে। লোকটাকে খুব চেনা মনে হচ্ছিল। কিন্তু স্মরণ করতে পারেননি। সে ফিসফিস করে কথা বলছিল। বিগ্রহ উদ্ধারের কাজ নাকি পুরোদমে চলছে। উদ্ধার হলেই সে যোগাযোগ করবে। তবে তরুণবাবুর ঠিকানা তার জানা দরকার। তরুণবাবু তাকে তার বন্ধুর বাড়ি ঠিকানা দেন এবং দুটো নাগাদ সেখানে দেখা করে কাজ কত দূর এগোলো তা জানাতে বলেন। এটা তরুণবাবুর একটা আইডিয়া। কারণ লোকটার সঙ্গে আরও কথা বলা দরকার। কেন তাকে তার চেনা মনে হয়েছে, এই খটকা দুর করার ইচ্ছে ছিল। ইতিমধ্যে আমি গিয়ে সব জানালাম তাকে। তখন উনি বললেন লোকটা এলে তাকে এখানে আমার আসার কথা জানাবেন। আমিই যে বিগ্রহ উদ্ধার করেছি, তাও জানাবেন। আমার হাত থেকে বিগ্রহ উদ্ধারের ফন্দি বাতলাবেন। অর্থাৎ তোমাকে ওদের হাতে তুলে দিতে হবে।
কর্নেল সকৌতুকে হাসলেন। লোকটা এই টোপ গিলবে কি না তরুণবাবুর অবশ্য সন্দেহ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সে টোপ গিলেছিল। এক সাঙ্যাতকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। বাইনোকুলারে দূর থেকে তোমার দুর্দশা দেখে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু কী আর করা যাবে? ওই সময় ওদের পুলিশ ধরলে বড় জোর একটা ছিনতাই কেট-টেস হত। তোমাকে কিডন্যাপ করার যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখানো যেত না। আবার বিগ্রহের প্রসঙ্গ তুললে বিগ্রহ রহস্য ফাঁস হয়ে যেত। শচীনবাবু নিশ্চয় এসে নাক গলাতেন। অনেক হ্যাঁপা ছিল না কি? তাঁর অলরেডি পুলিশের কাছে এ বিষয়ে ডায়েরি করা আছে।
এ-ও কম হ্যাঁপা গেল না আমার ওপর!
তা একটু থ্রিলিং অভিজ্ঞতা হল। মন্দ কী?
এইসময় বাইরে হর্ন বাজল। কর্নেল নড়ে বসলেন। একটু পরে বাংলোর পোর্টিকোতে গাড়ি থামার শব্দ হল। তারপর তরুণবাবু ঘরে ঢুকে ধপাস করে বসে বললেন, কর্নেল সায়েব। শেষ পর্যন্ত প্ল্যান ভেস্তে গেল! এতক্ষণ অপেক্ষা করেও বদমাসটা এল না। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। আর কী করা যাবে? বিগ্রহ হাতে পেয়েই কেটে পড়েছে! আমারই বোকামি হয়ে গেল।
কর্নেল হঠাৎ হা-হা করে হেসে উঠলেন।
তরুণবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, হাসছেন যে?
ওটা নকল বিগ্রহ মিঃ মুখার্জি।
নকল? সে কী!।
হ্যাঁ। হরিবাবুর বাসায় আপনাদের গৃহদেবতার ছবি দেখে আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছিল। জয়ন্ত যেদিন ওয়ার্ডগেম নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল, সেইদিন ও বাড়ি যাওয়ার পর আমি বৈষ্ণবদের আরাধ্য রাধাকৃষ্ণের প্রাচীন বিগ্রহ সংক্রান্ত বই পড়ছিলাম। ষোড়শ শতকে একই ছাদের বিগ্রহ তৈরি হত। সেই রাত্রে আমার স্নেহভাজন এক ভাস্করকে ফোনে ডেকে পাঠাই। তাকে একটি বিগ্রহ পরদিন তৈরি করে দিতে বলি। সাধারণ কালো পাথরের বিগ্রহ তৈরি করে নকল অলঙ্কারে সাজিয়ে দিয়েছিল সে। আমার স্মৃতি প্রখর। কী কী অলঙ্কার আপনাদের বিগ্রহে ছিল, আমার মনে স্পষ্ট। কাজেই নকল প্রাচীন শৈলীর বিগ্রহ তৈরিতে অসুবিধে হয়নি। অবশ্য তখনও জানতাম না, কেন এটা করলাম। হয়তো ভেবেছিলাম, এটা কোনও কাজে লাগতেও পারে। তবে–নাহ। সঠিক জানি না। ইনটুইশন বলতেও পারেন!
তরুণবাবু শুনছিলেন অবাক হয়ে। আবার বললেন, তা হলে ওটা নকল বিগ্রহ?
আমি বললাম, খুনী দুটো বলছিল, একই প্যাকেটে মোড়া আছে। প্যাকেট পেলেন কোথায়?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। প্যাকেটটা একই। যে প্যাকেটে শচীন্দ্রলাল মুখার্জি–
তরুণবাবু তার কথার ওপর বললেন, আগে বলুন, আসলটা কি সত্যিই আপনার কাছে আছে?
আছে। দেখাচ্ছি। তার আগে বলি, কীভাবে ওটার খোঁজ পেলাম। বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। সংক্ষেপেই বলি। শ্যামসুন্দরের নোটবইয়ের ওয়ার্ডগেম গ্র্যাব, রেয়ার, আর্টস, বেস্ট শব্দছকের কথা আজ দুপুরে আপনাকে বলেছিলাম। জয়ন্ত অক্ষরগুলো সংখ্যায় রূপান্তরিত করে টোটাল ফিগার ১৬০ দেখিয়েছিল। জয়ন্ত ইজ রাইট। এই সংখ্যাটা সত্যিই একটা সংকেত। এটাকে রোমানসংখ্যায় দেখলে হবে [ ঈ অর্থাৎ সি ১০০, এল ৫০ এবং এক্স ১০। তো আজ সকালে কুয়াশার মধ্যে ট্রাক ড্রাইভার আমাদের মুনলেক রোডের মোড়ে নামিয়ে দিয়েছিল। জঙ্গল এবং পাথরে ভর্তি চড়াই ভেঙে শর্টকাটে আসার সময় জয়ন্ত একখানে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। ওকে টেনে তুলতে গিয়ে একটা পাথর চোখে পড়ল। পাথরটা ছোট্ট একটা মাইলস্টোনের মতো মাটিতে পোঁতা ছিল। ঘাসের মধ্যে ইঞ্চি ছয়েক বেরিয়েছিল। ওতেই হোঁচট খেয়েছিল জয়ন্ত। চমকে গেলাম। পাথরটায় খোদাই করা আছে [ ঈ!ৈ সন্দেহ চেপে রাখলাম তখনকার মতে। দুপুরে আপনার সঙ্গে দেখা করে ফেরার সময় পাথরটা টানাটানি করে উপড়ে ফেললাম। এ আমার পক্ষে সহজ কাজ। তলায় নাইলনের দড়িতে বাঁধা পলিথিন পেপারে মোড়া একটা প্যাকেট ছিল। টেনে তুললাম। বাঁধন খুলে পলিথিন পেপারের মোড়ক ছাড়িয়ে আরও একটা মোড়ক দেখলাম। সেটা শক্ত খাকি রঙের প্যাকিং পেপার। ব্যস! বেরিয়ে পড়ল রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ। ছোট্ট বিগ্রহ। ৯ ইঞ্চি বাই ৬ ইঞ্চি সাইজ। তবে গয়নাগুলো নেই। শ্যামসুন্দর রত্নের লোভ সামলাতে পারেনি। বেচে দিয়েছিল নিশ্চয়।