তারপর দরজা খুলে একটা ছায়ামূর্তি ঘরে ঢুকল এবং দরজা বন্ধ করল। টর্চের আলো জ্বলছিল। তাই সেই রাক্ষুসে মুখোশে ঢাকা মুখটা দেখতে পেয়েছিলাম। গায়ে ফুলহাতা বেঢপ নীলচে সোয়েটার। পরনে নোংরা প্যান্ট কাদায় বিচিত্তির।
টর্চ নিভে গেল। পেয়েছ? দিয়েছে ব্যাটা ঘুঘু?
হুঁঃ!
এদিকে নিয়ে এস। মালটা দেখি।
আমার নড়া বারণ। তবে টের পেলাম আমার মাথার দিকে টর্চ জ্বেলে ওরা। মাল পরীক্ষা করছে।
এটাই বটে তো?
হুঁউ। একই প্যাকেট। খুলে দেখে নিয়েছি। গয়নাটয়না সব আছে।
শ্যামা হারামজাদা ট্রেচারি না করলে মারা পড়ত না।
ছাড়ো! বেরুনো যাক।
শোনো! এই খুদে টিকটিকিটাকে বরং শেষ করে ফেলো।
না, না। খুনখারাপি করার রিস্ক আছে।
শ্যামার মতো ইদারায় বডি ফেলে দিলেই হবে। তারপর পাথর ফেলে ঢেকে দেব। শ্যামার বডি এখনও ইদারার তলায় আছে। টের পেয়েছে কেউ?
বোকামি হবে বুঝছ না কেন? বুড়ো টিকটিকিকে সেবার ফাঁকি দেওয়া কঠিন হয়নি। এ ব্যাটা ওর কাছের লোক। তাছাড়া রক্তটক্ত পড়ে থাকবে। তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। ইদারায় জলও ছিল। এখন ইঁদারায় পাথর ভর্তি। রক্ত কিসে? চলো! এ ব্যাটা এমনিভাবে পড়ে থাক।
ওরা বেরিয়ে গেল। দরজা ভেজিয়ে দিয়েই গেল।
কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হলাম। হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করলাম। দ্বিতীয় বারের বাঁধনটা আগের মতো মজবুত ছিল না। গিট টানাটানি করে কবজিতে ব্যথা ধরে গেল। তারপর অবশেষে খুলে গেল। এবার পায়ের বাঁধন খুলে ফেললাম। তারপর মুখের টেপ খুলতে সে এক যন্ত্রণা!
ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে সাবধানে পা বাড়িয়ে এবং টলতে টলতে দেওয়াল হাতড়ে দরজা পেলাম। আমার বরাত! দরজা ওরা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে যায়নি।
হাতের যন্ত্রণা তেমন কিছু নয়। কিন্তু পায়ে খিল ধরে গেছে। বেরিয়ে গিয়ে বারান্দা পেলাম। এবার অন্ধকার কিছুটা স্বচ্ছ হয়ে উঠল। একটু পরেই জায়গাটা চিনতে পারলাম। সন্ধ্যানীড়ের একতলার একটা ঘরে ছিলাম।
কিন্তু বেরুনোর দরজা বন্ধ। অগত্যা উঠোনে নেমে গিয়ে পাঁচিল আঁকড়ে অনেক কষ্টে ওপরে উঠলাম। তারপর ঝাঁপ দিলাম। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলাম।
গাড়ির হেডলাইট লক্ষ্য করে বরমডিহি-জাহানাবাদ রোডে পৌঁছুলাম। তারপর উল্টোদিকে হিলটপ বাংলোর আলো চোখে পড়ল।
বাংলোর গেটে পৌঁছুতে কতক্ষণ সময় লেগেছিল জানি না। আমাকে দেখতে পেয়েছিল বৈজু। সে দৌড়ে এল। তারপর চাচামেচি শুরু করল, হুজুর। কর্নিলসাব! হুজুর। ছোটাসাব আয়া!
আশ্চর্য! কর্নেলের কোনও সাড়া পেলাম না। টলতে টলতে বারান্দায় উঠলাম। তারপর ঘরে ঢুকে দেখলাম, কর্নেল হেলান দিয়ে বসে চুরুট টানছেন।
উনি মুখ তুলে আমাকে দেখে একটু হাসলেন। আগে পোশাক বদলাও, ডার্লিং! বাথরুমে গরম জলে হাত-পা-মুখ ধুয়ে নাও! একেবারে পোডড়া বাড়ির ভূত হয়ে ফিরেছ। বলে হাঁক দিলেন, বৈজু! জলদি কফি লাও!
ক্ষোভে অভিমানে গুম হয়ে বাথরুমে গেলাম। একটু পরে পোশাক বদলে সোফায় বসলাম। কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। বৈজু এক পেয়ালা কফি রেখে গেছে। কফি পানের দরকার ছিল।
কর্নেল চোখ বুজেই বললেন, একটু রিস্ক ছিল তা অস্বীকার করছি না। তবে প্ল্যানমাফিক কাজ হয়েছে। তরুণবাবু যে ফাঁদ পেতেছিলেন, তা অনবদ্য। ওঁর সহযোগিতা না পেলে শ্যামবাবুর খুনীদের ধরার চান্স ছিল না। হ্যাঁ, খুনীরা এতক্ষণ অবশ্যই ধরা পড়ে গেছে। প্রতি মূহূর্তে আশা করছি, তরুণবাবুর গাড়ির হর্ন বেজে উঠবে।
এতক্ষণে মুখ খুলতে হল। আপনার সঙ্গে এই শেষ।
কর্নেল চোখ খুলে হাসলেন। শেষ কী জয়ন্ত? শুরু বলো!
আশ্চর্য! আপনি আমাকে একলা ফেলে রেখে—
কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তরুণবাবুর প্ল্যান!
তার মানে?
তরুণবাবু গত রাত্রে আমাদের সঙ্গে ট্রেনেই এসেছেন। এ. সি. কামরায় ছিলেন। ওঁর জিপে আসানসোল হয়ে আসার ব্যাপারটা একটা চাল মাত্র। তাছাড়া আমার সঙ্গে পরামর্শেরও দরকার ছিল। কিন্তু তখনও আমি বিগ্রহ কোথায় আছে জানতাম না। আজ সকালে এখানে আসার পথে দৈবাৎ যখন বিগ্রহের সন্ধান পেলাম, তখন আবার নতুন প্ল্যান ছকতে হল। চলে গেলাম ওঁর কাছে। কথা মতো উনি উঠেছিলেন ওঁর এক বন্ধুর বাড়িতে। উনি বললেন, পুরো প্ল্যান সত্যি বদলানো দরকার। খুনীদের একবারে হাতেনাতে ধরতে হবে নইলে পুলিশ নিছক সন্দেহক্রমে ওদের ধরার ঝুঁকি নেবে না। আদালতে কিছু প্রমাণ করাও কঠিন হবে। শ্যামসুন্দরের লাশই তো পাওয়া যায়নি। ওদের হাতে যাওয়া দরকার। কিন্তু কী ভাবে তা ওদের হাতে যাবে? তখন তরুণবাবু বললেন, জয়ন্তবাবুকে কাজে লাগানো যাক। হাতার আগে বলা দরকার, বিগ্রহচোর শ্যামবাবুর খুনীদের একজন কলকাতাতেই তরুণবাবুর সঙ্গে ইদানীং ফোনে যোগাযোগ রাখত। সে বলত, বিগ্রহ উদ্ধার করতে পারলে তরুণবাবুকেই সে দেবে। তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে। তরুণবাবু প্রথমে রাজি হননি। পরে রাজি হন। কেন রাজি হন, বলছি। উনি ঠিক করেন, বিগ্রহ পেলে বেনামী চিঠি লিখে ওঁর দাদা শচীনবাবুকে জানাবেন, মামলা মিটমাট করে নিলে বিগ্রহ ফেরত পাবেন। আর মামলা মিটমাট করার মানে তরুণবাবুর মাকে মহেন্দ্রবাবুর বিবাহিতা স্ত্রী বলে স্বীকার করে নেওয়া। এখানেই তো তরুণবাবুর যত ক্ষোভ!
বললাম, কিন্তু আমাকে কাজে লাগানো ব্যাপারটা কী? কী বাঁচা বেঁচেছি, এখনও তো শোনার মর্জি নেই আপনার।