তবে কর্নেলের ওইভাবে পিছল পাথরে নেচে-নেচে চলা সম্ভবত পর্বতারোহীদেরও দুঃসাধ্য। সত্যিই যেন ঝরনার সঙ্গে ব্যালে নৃত্য করতে গেলেন।
গেলেন তো গেলেনই। আর ফিরে আসার নাম নেই। একবার ডাকলাম, কর্নেল!
কোনও সাড়া এল না। তখন কয়েক পা এগিয়ে গেলাম। এখানে মাটিটা ভেজা এবং পাথরের ফাঁকে ঘন সবুজ ঘাস গজিয়েছে। বাঁদিকে কাটাঝোঁপের নীচে ঝরনা। ডানদিকে নিরেট পাথরের পাঁচিল মতো।
আচমকা সেই পাঁচিল থেকে দুটো লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। এক পলকের জন্য দেখলাম তাদের মুখে রাক্ষসের বা ভয়ঙ্কর কিছুর মুখোস।
ভিজে ঘাসে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার পিঠে বসে একজন ছুরির ডগা ঠেকাল গলায়। অন্যজন মুখে টেপ সেঁটে দিল। চোখে রুমাল বাঁধল। তারপর পিঠমোড়া করে আমার দুটো হাত দড়ি দিয়ে বাঁধল। পা দুটোও বেঁধে ফেলল। আমি আতঙ্কে হতবুদ্ধি হলেও চেঁচানোর চেষ্টা করিনি। কারণ গলায় ছুরির ডগা।
ওই অবস্থায় তারা আমাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল। কখনও টের পেলাম চড়াইয়ে উঠছি, কখনও বুঝলাম ঢাল বেয়ে নামছি। ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
কতক্ষণ পরে একখানে আমাকে মড়ার মতো নামিয়ে রেখে একজন চাপা স্বরে বলল, একটু পরে রাস্তা পেরোতে হবে। এখনও পিকনিকওয়ালাদের গাড়ি যাচ্ছে।
এখানেই শেষ করে দে না খুদে টিকটিকিটাকে।
নাহ্। বুড়ো টিকটিকিটার সঙ্গে রফা করতে হলে এটাকে এখনও জ্যান্ত রাখতে হবে। ও ব্যাটা এক ঘুঘু। মালের হদিস ও ব্যাটা ঠিকই জানে।
বুঝতে পারলাম, কর্নেলের ওপর আমার বাঁচা-মরা নির্ভর করছে।
০৯. বিগ্রহ এবং CL-X
ওরা আমাকে একটা ঘরের মেঝেয় মড়ার মতো চিৎ করে শুইয়ে রেখেছিল। চোখের বাঁধন খুলে দিয়েছিল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ঘর। কিছুক্ষণ পরে আমার মাথার দিক থেকে একজন গলায় ছুরির ডগা ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল, এই ব্যাটা! বাঁচতে যদি চাস, ওই ঘুঘু ব্যাটাচ্ছেলেকে একটা চিঠি লেখ।, বলব লিখবি। কৈ হে? কাগজ কলম দাও। দেরি করা যাবে না।
মাথার দিকে টর্চের আলো জ্বলল। পুরনো জরাজীর্ণ ঘর। পলেস্তারা খসে গেছে। এটা সেই সন্ধ্যানীড় নয় তো?
খসখস করে কাগজ ছেঁড়ার শব্দ হল। তারপর একজন আমাকে কাত করে হাতের বাঁধন খুলে দিল। আগের জন তেমনই ভুতুড়ে গলায় বলল, কিসের ওপর কাগজ ফেলে লিখবে? নোটবইটা দাও। ওটার ওপর লিখুক।
আমার চোখের সামনে ফুলহাতা সোয়েটার পরা একটা হাতে শ্যামসুন্দরের সেই কালো নেটবইটা এবং তারই একটা ঘেঁড়া পাতা দেখতে পেলাম। বুঝলাম, হরিবাবুর কাছ থেকে এরাই তা হলে নোটবইটা হাতিয়েছিল। গলায় ছুরির ডগা এবং মুখে টেপ সাঁটা। চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় কী?
যা বলছি লেখ। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বরাবরেষু।
লিখলাম। হাতের লেখা জড়িয়ে যাচ্ছিল।
এবার লেখ। আপনি অত্র পত্রপাঠকপূর্বক মাল মুনলেক রোডের মোডে মাইল স্টোনের পিছনে রাখিয়া দিবেন। সাবধান! কাহাকেও জানাইবেন না। আমি বন্দী হইয়াছি। মাল পাইলে আমার প্রাণ বাঁচিবে। আপনি পুলিশ কিংবা নিজের জোরে হস্তক্ষেপ করিলে আমার গলা শ্যামসুন্দরের মতো ফাঁক হইয়া যাইবে। ইহারা নজর রাখিয়াছে। আমার প্রাণরক্ষা করুন। ইতি। নাম সই কর। হ্যাঁ– জয়ন্ত চৌধুরি।
অন্যজন ভুতুড়ে গলায় বলল, পুনশ্চ লেখাও। টাইম দিতে হবে না?
ঠিক, ঠিক। এই ব্যাটা! পুনশ্চ লেখ। রাত্রি দশটা পর্যন্ত সময়। দশটা বাজিয়া গেলেই আমার গলা ফাঁক। হুঁ। ফের সই কর। তারিখ লেখ। গুড! এই! এক্ষুণি চলে যাও। হিলটপের গেটের সামনে ঢিল চাপা দিয়ে রেখে এসো। সাবধান। গুঁড়ি মেরে ঝোঁপের মধ্যে এগোবে। বুঝেছ? তুমি ধরা পড়লে মাল পাব না। কিন্তু এ ব্যাটার গলা ফাঁক হবে এই যা!
শুনেই আমার মাথা ঘুরে উঠল। টর্চ ততক্ষণে নিভে গেছে। আবার আমাকে কাত করে হাত দুটো বাঁধল ওরা। ছুরির ডগা সরে গেল। অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি দরজা ফাঁক করে বেরিয়ে গেল। দরজা আবার বন্ধ হল। মাথার কাছের লোকটা হুমকি দিল, নড়বে না। নড়লেই গলা ফাঁক। কারণ চিঠি তো লিখেই দিয়েছ। আর তুমি বাঁচলেই বা কী, মরলেই বা কী? তবে খামোকা এই শীতের রাত্তিরে ছুরি চালাতে ইচ্ছে করছে না। ইস! হাত দুটো ঠাণ্ডায় পাথর হয়ে গেছে। একটু আগুন জ্বেলে সেঁক দিতে পারলে হত। দেখা যাক।
এতক্ষণে গলাটা একটু চেনা মনে হল, যদিও ফিসফিস করে কথা বলছিল সে। হারাধন নাকি? কে জানে! চুপ করে পড়ে থাকাই ভাল। কর্নেলের পাল্লায় পড়ে এমন ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়, কিন্তু এবার যা বুঝছি, বাঁচার আশা কম। কারণ কর্নেল সহজে হার স্বীকার করতে চাইবেন না। দুর্ভাবনায় বুকের স্পন্দন বেড়ে গেল।
মাথার কাছের লোকটা ফস্ করে দেশলাই জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাল। যেন ইচ্ছে করেই আমার মুখের দিকে ধোঁয়া ছাড়ছিল সে। মুখে টেপ সাঁটা। কাশি আসছিল। কাশবার চেষ্টা করতেই আবার গলায় ছুরির ডগা। চুপ ব্যাটা! টু শব্দ করলেই জবাই করব।
সময় কাটছিল না। ফাঁসির আসামীদের মনের অবস্থা বুঝি এইরকমই হয়। শেষ পর্যন্ত হয়তো তারা আমার মতোই মরিয়া হয়ে ওঠে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য।
কতক্ষণ–কতক্ষণ পরে বাইরে কোথাও দুবার কেউ শিস দিল। আমার মাথার কাছে বসে থাকা লোকটাও পাল্টা দুবার শিস দিল।