আপনার সায়েবের সঙ্গে তার বৈমাত্রেয় দাদার এখানকার একটা বাড়ি নিয়ে নাকি মামলা চলছে?
সন্ধ্যানীড় নিয়ে। সব জানি। এখন মামলা সুপ্রিম কোর্টে উঠেছে। তবে স্যার বাড়িটার খুব বদনাম আছে। বাড়ি ফেলে রাখলেই ভূতপ্রেতের আখড়া হয়। বুঝি না, সায়েবের কেন এত জিদ!
আপনি কখনও ঢুকেছেন ও বাড়িতে?
নন্দবাবু হাসলেন। আমার মাথা খারাপ হয়েছে? দিনদুপুরেই ওই হানাবাড়ির। কাছ ঘেষে না স্থানীয় লোকেরা। তাছাড়া দরজায় তালা বন্ধ। আদালতের হাতে। বাড়িটার জিম্মা। পুলিশ আর ভূত উভয়কেই মানুষ ভয় করে স্যার!
কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। ঠিক বলেছেন! বলে বাইনোকুলারে সম্ভবত কোনও পাখি দেখতে থাকলেন।
নন্দবাবু ঝাড়ুদারনীকে তম্বি করতে গেলেন। লক্ষ্য করলাম, অনবরত কোনও না-কোনও গাছে হলুদ পাতা খসে পড়ছে। শীতের হাওয়া এই উঁচুতে বেশ জোরে বইছে। কাজেই বেচারির দোষ কী? একটু পরে নন্দবাবু আবার আমাদের সঙ্গে গল্প করতে এলেন। বরমডিহিতে একসময় বাঙালিদের কত রবরবা ছিল, কত দাপট ছিল এবং কোন পুজোয় কত ধুমধাম হত, এইসব নিয়ে বকবক করে চললেন।
বাইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল তাঁর কথা শুনছিলেন। বললেন, আচ্ছা নন্দবাবু, আপনার সায়েবের দাদা শচীনবাবু–
বৈমাত্রেয় স্যার! সেইজন্যেই তো এই মামলা মোকর্দমা!
শচীনবাবু আর এখানে আসেন না?
কই, তাকে তো অনেক বছর এখানে আসতে দেখি না। ওই বাড়িটা নিয়ে মামলা খুব বেশিদিনের নয়। কিন্তু আমি তো স্যার, বাড়িটার চেহারা বরাবর একইরকম দেখছি। সায়েবের বাবার তৈরি বাড়ি। কখনও-সখনও কলকাতা থেকে বড়সায়েবের লোকজন এসে থাকত দেখেছি। কিন্তু ভূতের বদনাম ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি।
এই বাড়িটা হিলটপ–দেখলাম তিন বছর আগে তৈরি হয়েছে। আপনি কি গোড়া থেকেই কেয়ারটেকারের কাজ করছেন?
না স্যার! আমি আমার সায়েবের ব্রাঞ্চ অফিসে চাকরি করতাম। বছর দুই হয়ে এল, সায়েব আমাকে এই কাজ দিয়েছে।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। আমরা একটু বেড়িয়ে আসি। মিঃ মুখার্জি সম্ভবত সন্ধ্যার আগে পৌঁছুতে পারবেন না। আমরা তার আগেই ফিরে আসব। বলে লনে হাঁটতে থাকলেন।
ওঁকে অনুসরণ করে বললাম, বাপস্! কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল। আপনিও কিন্তু আজকাল বড্ড বেশি কথা বলেন।
কর্নেল হাসলেন। তোমাকে বলেছিলাম, কথা বলতে বলতে দরকারি কথা বেরিয়ে আসে। মোটামুটি একটা ছবি পাওয়া গেল কি না বলো? তবে সবচে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, কালো দৈত্যের হামলার দিন অর্থাৎ ২৫ অক্টোবর শ্যামসুন্দর এই বাংলোবাড়িতে এসেছিল এবং তরুণ মুখার্জির সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। তারপর সেদিনই সন্ধ্যায় সে সন্ধ্যানীড়ের দোতলায় খুন হয়েছিল। আমরা দৈবাৎ ওই সময় গিয়ে পড়ায় ঝটপট একটা নাটকের দৃশ্য অভিনীত হয়।
তা ঠিক। তাতে হারাধন অন্যতম অভিনেতা। কিন্তু শচীনবাবুর ভূমিকায় কে ছিল?
তুমি নাকি উঠোনের জঙ্গলে একটা ছায়ামূর্তি দেখেছিলে বিদ্যুতের ছটায়?
হ্যাঁ ঠিকই দেখেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে বলেছিলাম।
তাহলে তিনজন ভিলেন, একজন ভিকটিম। ভিকটিম শ্যামসুন্দর। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, সে একটা ফাঁদে পা দিয়েছিল। কর্নেল গেট থেকে বেরিয়ে বললেন, ও সব কথা এখন থাক। আমরা প্রকৃতিকে কলুষিত করতে চাই না খুনোখুনির কথা বলে। চলো, নিষ্পাপ সৌন্দর্যের মধ্যে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করি।
প্রকৃতি এখন বেজায় হিংস্র। ভীষণ ঠাণ্ডা।
কর্নেল চুপচাপ বাঁদিকে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকলেন। আমরা আজ সকালে এই জঙ্গলের উল্টোদিক হয়ে এসেছি। এদিকে পাথর নেই। গাছগুলো উঁচু। শীতে পাতা ঝরে প্রায় ন্যাড়া হয়ে গেছে এবং ভেতরটা অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু শুকনো পাতার স্তূপ সর্বত্র। পা ফেললেই বিচ্ছিরি শব্দ হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলাম, এদিকে যাচ্ছিটা কোথায়?
একটা ঝরনা আছে এদিকে। ছোট্ট হলেও সুন্দর। তবে টুরিস্ট বা পিকনিকবাজদের ওটা পছন্দসই নয়। পাথর আর বালির ওপর দিয়ে ছটফটিয়ে চলা একফালি স্রোত ত্র। কর্নেল চোখ নাচিয়ে বললেন, ঝরনার ধারে পাথরের ফাঁকে এক বিরল প্রজাতির ক্যাকটাস দেখেছি। এসব ক্যাকটাস বালি পাথর এবং জল এই তিনটেই চায়। রোদ্দুরও চায় এরা–ওয়াটার ক্যাক্টি বলা হয়। সচরাচর মরূদ্যানেই এদের দেখা মেলে। তাই আমার অবাক লেগেছে।
ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে জঙ্গলটা। তারপর সতেজ গুল্মলতা চোখে পড়ল পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে। আবছা জলের শব্দ কানে এল। কিছুক্ষণ পরে ঝরনাটা দেখতে পেলাম। সুন্দর ঝরনা তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু দুধারে ঘন কাটাঝোপ। কর্নেল কাটাঝোঁপের সমান্তরালে ঝরনার ভাটির দিকে হাঁটছিলেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, ভুল করছি না তো? দুপুরে দেখে গেছি। ছবি। তুলেছি। তুমি এখানে অপেক্ষা করো। আমি খুঁজে দেখি।
বলে কর্নেল কাঁটাঝোপ সাবধানে ফাঁক করে ঝরনার পিচ্ছিল পাথরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে পা ফেলতে ফেলতে অদৃশ্য হলেন। বুঝলাম, ওইভাবে চলা আমার পক্ষে সম্ভব নয় বলেই কর্নেল একা গেলেন। মিলিটারির লোক বলে কথা।
অবশ্য আমিও কিছুদিন মাউন্টেনিয়ারিংয়ে ট্রেনিং নিয়েছিলাম ওঁর পরামর্শে। কি খবরের কাগজের একজন রিপোর্টারের পক্ষে সেই ট্রেনিং কী কাজে লাগবে ভেবে পুরো কোর্স শেষ করিনি।