মাঝে মাঝে কর্নেলের এইসব হেঁয়ালি ন্যাকামি মনে হয়। বিরক্ত হয়ে চুপ করে থাকলাম।
কর্নেল বললেন, যা বলছিলাম। কষ্ট করে আরোহণের সময় পদঙ্খলন হতেই পারে। একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে কষ্ট করে মানুষ এগোচ্ছে। হঠাৎ পা পিছলে পতন। দা আইডিয়া!
বৈজু বারান্দার টেবিলে ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল।
মাখনটোস্টে কামড় দিয়ে কর্নেল বললেন, তো যেখানেই কেষ্ট সেখানেই রাধা।
ওঃ কর্নেল! আপনি বিগ্রহ পেয়ে গেছেন বলছিলেন?
দা আইডিয়া! আইডিয়া যদি সঠিক হয়, তা বাস্তবে কাজে লাগালেই সঠিক প্রাপ্তি। যা চাইছি, তা পেয়ে যাবই। তোমার পতনের সময় যে আইডিয়া মাথায় এসেছিল তা সঠিক বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কাজেই বিগ্রহ পেয়ে গেছি, এটা নিশ্চিত। শুধু উদ্ধারের অপেক্ষা মাত্র।
নাহ্। আর মুখ খুললে আবার ক্রমাগত হেঁয়ালি শুনতে হবে। কাজেই চুপচাপ ব্রেকফাস্টে মন দেওয়াই উচিত।……
০৮. শত্রুপক্ষের কবলে
ট্রেন জার্নির ধকল এবং প্রচণ্ড শীতের দরুন কর্নেলের সঙ্গে বেরুনোর ইচ্ছে ছিল না। কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। কর্নেল সেই তুর্কি প্রজাপতির খোঁজে বেরুচ্ছেন বলে গিয়েছিলেন। এই সাংঘাতিক শীতেও নাকি ওই প্রজাতির প্রজাপিত কাবু হয় না। ধরতে না পারুন, ক্যামেরায় তার ছবি না তুলে ছাড়বেন না।
একটা নাগাদ প্রকৃতিবিদ ফিরলেন। ততক্ষণে আমি গরম জলে স্নান করে। ফিট হয়ে গেছি। কর্নেল সপ্তাহে একদিন স্নান করেন। আজ তার মানের দিন নয়। পোশাক বদলে বৈজুকে লাঞ্চ রেডি করতে বললেন।
জিজ্ঞেস করলাম, তুর্কি ঘোড়সওয়ারের দেখা পেলেন নাকি?
নাহ্। সারা তল্লাটে পিকনিকবাজদের হুল্লোড়। আর মাইক্রোফোনে ফিল্মি। গান! মুনলেকের চারদিকেও একই অবস্থা, কালো দৈত্য হানা দিলে খুশি হব।
সন্ধ্যানীড়ে যাননি?
কর্নেল হাসলেন। একটা উঁচু টিলার মাথায় চড়ে বাইনোকুলারে বাড়িটার ওপর লক্ষ্য রেখেছিলাম কিছুক্ষণ। সন্দেহজনক কিছু দেখিনি। দেখলে ক্যামেরায় টেলিলেন্স ফিট করে ছবি তুলে নিতাম।
কথাটা সেই মুহূর্তে মাথায় এল। বললাম, আচ্ছা কর্নেল, ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় আপনার সঙ্গে ক্যামেরা ছিল। কিন্তু শ্যামবাবুর লাশের ছবি তোলেননি কেন?
এতদিন পরে কথাটা তুমি জিজ্ঞেস করছ?
খেয়াল হয়নি। আপনার কথায় এটা এতদিন পরে মাথায় এল।
কর্নেল আস্তে বললেন, তখন ক্যামেরায় আর ফিল্ম ছিল না। তুমি তো দেখেছিলে, সেদিন বিকেলে মুনলেকে ফিল্মের রোলটা উজাড় করে ফেলেছিলাম। পাখি আর প্রজাপতির অবাধ রাজত্ব তখন। কালো দৈত্যের ভয়ে শরৎকালে তল্লাটে তখন ট্যুরিস্ট বা পিকনিকবাজরা পা বাড়ায় না।
ডাইনিং রুমে জোরা কৃপাসে পায়ের ধুলো দেওয়ার জন্য ডাকতে এল বৈজু। লোকটি অত্যন্ত বিনয়ী এবং সত্যিকার সেবাভক্তিপরায়ণ।
খাওয়ার সময় এতক্ষণে সাইকেলে চেপে নবাবু এলেন। নমস্কার করে বললেন, বাজার-টাজার করে দিয়ে গিয়েছিলাম। দেখলাম ইনি ঘমোচ্ছেন। ডিসটার্ব করলাম না। বৈজু বলল, কর্নেলসায়েব বেরিয়েছেন। আপনারা খাওয়া-দাওয়া করুন স্যার। আমি চৌহদ্দি ঘুরে দেখি, সব ঠিকঠাক আছে কি না। সায়েব বড্ড খুঁতখুঁতে মানুষ। লনে একটু কিছু পড়ে থাকলে কিংবা বাগানের গাছপালার তলায় আবর্জনা দেখলে খাপ্পা হন। লোক আসছে। বিকেলের মধ্যে সব ঝকঝকে তকতকে করে ফেলবে।
খাওয়ার পর ফুলবাগানের মধ্যে একটা গোলাকরা খোলামেলা বেদিতে গিয়ে। বসলাম দুজনে। ততক্ষণে এক ঝাড়ুদারনী এবং একজন লোক এসে গেছে। মনে হল, দরকার ছিল না ওদের। বৈজু সব ঝকঝকে করেই রেখেছে।
নন্দবাবু তদারক করছিলেন। কর্নেল ডাকলেন, আসুন নন্দবাবু! একটু গপ্প করা যাক।
নন্দবাবু কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন।
কর্নেল বললেন, আচ্ছা নন্দবাবু, আপনি শ্যামসুন্দরবাবু নামে কাউকে চেনেন?
শ্যামসুন্দর স্যার?
হ্যাঁ। আপনার সায়েবের কলকাতার অফিসে একসময় চাকরি করতেন ভদ্রলোক।
নন্দবাবু বিকৃত মুখে বললেন, একের নম্বর ধড়িবাজ। সায়েবের মুখে শুনেছি, চুরিচামারি করে পালিয়েছিল।
আপনার সায়েব বলছিলেন গত অক্টোবরে এই বাংলোবাড়িতে সে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।
হ্যাঁ স্যার। দুপুরে এসেছিল। সেই প্রথম ওকে মুখোমুখি দেখেছি। খুব ভঁট দেখাচ্ছিল এসে।
কী ব্যাপারে?
নন্দবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, সেটা ঠিক বলতে পারব না স্যার! মনে হচ্ছিল খুব ভঁটের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। সায়েব ওকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা এঁটে কথা বলছিলেন। আবছা কানে এসেছিল খুব তর্কাতর্কি হচ্ছে। তারপর হঠাৎ দরজা খুলে সায়েব ওকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন। হুমকি দিয়ে বললেন, ফের যদি আমার সামনে কখনও দেখি, গুলি করে মারব। শ্যামসুন্দর চুপচাপ চলে গেল।
আপনি সায়েবকে জিজ্ঞেস করেননি কিছু?
না স্যার! আমি ওঁর কর্মচারী। উনি আমার রুজির মালিক। তবে সায়েব পরে শুধু বললেন, জানো, নন্দ? এই বদমাইসটা আমার কলকাতার অফিসে ক্লার্ক ছিল। খুব বিশ্বাস করতাম ওকে। আমার একটা ইমপর্ট্যান্ট ফাইল চুরি করে পালিয়েছিল। তো সায়েবের এই কথা শুনে মনে হয়েছিল, শ্যামসুন্দর সায়েবকে ব্ল্যাকমেল করতেই এসেছিল। সায়েবের দেশবিদেশে ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের কারবার আছে। বুঝতেই পারছেন, আজকাল এই কারবারে অনেক বে-আইনি কাজকর্ম হয়। আমি আদার ব্যাপারী। জাহাজের খবরে আমার কাজ কী?