কিছুক্ষণ পর বৈজু ট্রে নিতে এল। কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, আচ্ছা বৈজু! দেখো তো ইধার। ইয়ে আদমিকো পহচানতা তুম?
কর্নেল পকেট থেকে শ্যামবাবুর ছবি বের করে তাকে দেখালেন। বৈজু ঝুঁকে ছবিটা দেখল। গম্ভীর মুখে বলল, মালুম, কোহি জগাহ্ পর দেখা। লেকিন য়্যাদ নেহি আতা।
খ্যালসে দেখো, বৈজু!
সে মাথা চুলকে বলল য়্যাদ নেহি আতা হজুর!
আচ্ছা! ইয়ে চার পিকচার দেখো!
কর্নেল পকেট থেকে শ্যামসুন্দরের চারটে রিটাচ করা ছবি টেবিলে সাজালেন। এইসব ছবিতে বয়সের ছাপ দেওয়া হয়েছে এবং কোনও ছবিতে গোঁফ, কয়েকরকম ছাঁটের দাড়ি আঁকা।
বৈজু ঝুঁকে ছবিগুলো দেখছিল। চিবুকে দাড়িওয়ালা ছবিটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে একটু হাসল। ইয়ে তো ওহি আদমি।
কৌন?
দেড়-দো মাহিনা আগে সাব কা সাথ মুলাকাত করনে আয়া।
উসটাইম তুমকা সাব হেঁয়া থা?
সাব দো-দিনকে লিয়ে আয়া, হজুর! ফির চলা গেয়া কলকাত্তা।
ইয়ে আদমি উনহিকা সাথ চলা গেয়া?
নেহি হুজুর! সাব একেলা চলা গেয়া। ইয়ে আদমিকা সাথ সাবকা বহত বাতচিত করার হুয়া। সাব ইসকো নিকাল দিয়া ঘরসে।
দো মাহিনা নেহি! দেড় মাহিনা আগে।
বৈজু একটু হাসল। হোগা দেড় মাহিনা। তো কাহে হামকো ইয়ে সব বাত পুছতা হুজুর?
কর্নেল পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট ওর হাতে দিয়ে বললেন, বখশিস্ বৈজু। কিসিকো মাত বোলো হাম তুমকো পিকচার দেখায়, কী ইস্ তরাহ কোই বাত কিয়া। সমঝা?
হাঁ হুজুর!
সে সেলাম ঠুকে সন্দিগ্ধ ভঙ্গিতে ট্রে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বললাম, তা হলে দেখা যাচ্ছে, তরুণবাবুও আপনাকে অনেক কথা গোপন করছেন! অক্টোবরে শ্যামবাবুর সঙ্গে তরুণবাবুর এখানে দেখা করার কথা ছিল এবং দেখা হয়েছিল। সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সম্ভবত বিগ্রহের দরদাম নিয়ে তর্ক হয়েছিল। বেশি দাম চাওয়ায় চটে গিয়ে তরুণবাবু তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। কিও আমার অবাক লাগছে, তরুণবাবু বিগ্রহচোরকে তক্ষুনি পুলিশে দেননি। কেন? তারও পূর্বপুরুষে অমূল্য সম্পদ ওই বিগ্রহ। চোরকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দিলেন কেন?
কর্নেল চোখ বুজে চরুট টানছিলেন। আমার কথাগুলো যেন ওর কানে ঢুকল না। হঠাৎ চোখ খুলে বেমক্কা হাঁক দিলেন, বৈজু! ইধার আও! বৈজু কিচেনের দিক থেকে সাড়া দিল। তারপর তেমনই সন্দিগ্ধ ভঙ্গিতে আড়ষ্টভাবে ঘরে ঢুকে সেলাম দিল।
কর্নেল বললেন, ঔর এক পিকচার দেখো বৈজু!
উনি এবার পকেট থেকে জাল ভোলা ওরফে হারাধনের ছবি বের করে দেখালেন। বৈজু কঁচুমাচু হেসে বলল, হুজুর। ইয়ে তো সাবকা সাথ কলকাত্তাসে আয়া। সাবকা সাথ চলাভি গেয়া। ইস্কা নাম–
হারাধন।
হাঁ হুজুর! সাবকা নোকর-উকর হোগা। লেকিন বলে সে হাত জোড় করল। হুজুর! মুঝে মালুম নেহি পড়ে, কাহে আপ ইয়ে সব বাত পুছতা! হাম গরিব আদমি হুজুর! নোকরি চলা যায় তো ভুখসে মর যায়েগা।
কর্নেল আর একটা দশ টাকার নোট ওর হাতে গুঁজে দিয়ে ওকে আশ্বস্ত করলেন। বৈজু আড়ষ্টভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কর্নেল হিন্দিতে বললেন, তোমার সায়েব থাকার সময় কি এখানে কালো দৈত্যের উপদ্রব হয়েছিল?
বৈজু বলল, হ্যাঁ হুজুর! তার পরদিন সায়েব কলকাতা ফিরে গিয়েছিলেন।
কর্নেল আপন মনে বললেন, ২৬শে অক্টোবর তরুণবাবু কলকাতা ফিরে যান।
হুজুর?
কিছু না তুমি এস বৈজু। চিন্তা কোরো না। এসব কথা কেউ জানবে না।
বৈজু চলে গেল। কর্নেলকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বাইনোকুলার হাতে বাইরের বারান্দায় গেলেন উনি। বাইরে ততক্ষণে রোদ ফুটেছে।
একটু পরে বারান্দায় গেলাম। দেখলাম লনে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ বাইনোকুলারে কিছু দেখছেন। জায়গাটা উঁচু বলে চারদিকে বহু দূর দেখা যাচ্ছে। পূর্বদিকে গাছপালার ফাঁকে একটা চওড়া পিচের পথ দেখতে পেলাম। তারপরই চোখে পড়ল–হ্যাঁ, ওই তো সেই পোড় দোতলা বাড়িটা! অত দূর থে যেন হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে। কঙ্কালের মতো ভয়ঙ্কর একটা বাড়ি।
কর্নেল হঠাৎ ঘুরে একটু হেসে বললেন, বাইনোকুলারে ভুতুড়ে বাড়িটা দেখবে নাকি জয়ন্ত?
নাহ্! আপনি দেখুন!
ব্রেকফাস্টের সময় হয়ে এল। খেয়ে নিয়ে বেরুব। তুমি—
ঝটপট বললাম, নাহ্। ঘুমোব।
কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। তোমার মনে যে প্রশ্নগুলো এসেছে, আমার মনেও এসেছে। তবে এখন এ নিয়ে মাথা ঘামানোর অর্থ হয় না। তরুণবাব। আসুন। তারপর আশা করি, ব্যাখ্যা পেয়ে যাব। ওঁর এখানে আসার উদ্দেশ্য আমাকে ব্যাখ্যা দেওয়া এবং বৈমাত্রেয় দাদাকে চিট করা। এক ঢিলে দুই পাখি বধ। ওয়েট অ্যান্ড সি।
আপনি বলেছিলেন বিগ্রহের খোঁজ পেয়ে গেছে। কোথায় কীভাবে পেলেন?
সমস্যা হল, জয়ন্ত! কখন আমার মুখ দিয়ে একটা কথা বেরিয়ে যায় এবং তুমি তা নিয়ে বড় বেশি চিন্তাভাবনা করে ফেলো! ওটা একটা আইডিয়া।
আহা, খুলে বলতে অসুবিধা কী?
কর্নেল বারান্দায় এসে বেতের চেয়ারে বসলেন। আমিও বসলাম। কর্নেল বললেন, বনজঙ্গল, পাথর, তার ফের চড়াই ভেঙে ওঠার সময় বাংলা প্রবচনটা আমার মাথায় এসেছিল : কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। হ্যাঁ, কষ্ট কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একবার হোঁচট খেতে দেখলাম তোমাকে। দ্বিতীয়বার হোঁচট খেয়ে তুমি পড়ে গেলে। তোমাকে টেনে ওঠালাম। ওঠাতে গয়ে আইডিয়াটা মাথায় এল।
উনি থেমে গেলেন হঠাৎ। হাঁক দিলেন, বৈজু ব্রেকফাস্ট লাও!