লোকটার চেহারা পোশাক এবং কণ্ঠস্বরে বুঝলাম এ বাড়ির সম্ভবত পুরাতন ভৃত্য। কর্নেল প্রায় তাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলেন। আমিও ঢুকলাম। লোকটা একটু হকচকিয়ে গেল। কর্নেল এবার একটু হেসে বললেন, বাইরের অবস্থা দেখেও কি এ কথা জিজ্ঞেস করতে আছে? দেখতে পাচ্ছ তো, আমরা কী বিচ্ছিরি ভিজেছি। যাই হোক, বৃষ্টিটা থামলেই আমরা চলে যাব।
লোকটা ধাতস্থ হল যেন। বলল, তা বসুন আজ্ঞে! আমি কর্তাবাবুর কাছে গিয়ে বসি। ওনার শরীর হঠাৎ অসুস্থ। বাড়িতে আর কেউ নেই যে আপনাদের একটু যত্নআত্তি করবো। বাড়তি একটা আলোও নেই যে—
থাক। তুমি তোমার কামশাইয়ের কাছে যাও। বৃষ্টি থামলে আমি তোমাকে ডাকব। তখন এসে দরজা বন্ধ করবে। কী নাম তোমার?
আজ্ঞে ভোলা স্যার!
তোমার কর্তামশাই কি এস. এল. মুখার্জি?
আজ্ঞে। বলে লোকটা হন্তদন্ত ভেতরের দরজা দিয়ে ঢুকে গেল। তারপর তার পায়ের শব্দ ক্রমশ ওপরদিকে মিলিয়ে গেল। সিঁড়িটা দরজার কাছাকাছি। আছে। কিংবা এ বাড়িতে সব শব্দই বিভ্রান্তিকর যেন। ততক্ষণে ঘরের ভেতরটা দেখে নিয়েছি। কয়েকটা আলমারি, একপাশে একটা খালি তক্তাপোস আর একটা টেবিল ঘিরে চারটে নড়বড়ে চেয়ার। দুটো চেয়ারে আমরা বসেছি। বুঝলাম, আইনজীবী ভদ্রলোকের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। তিনি বৃদ্ধ এবং অসুস্থ। আর কোর্টে যাতায়াতের সামর্থ নেই। আলমারিগুলো প্রায় শূন্য। আইনজীবীদের ঘরের দৃশ্য আমার দেখা আছে। অজস্র আলমারিতে ঠাসবন্দি আইনের বই এবং নথি ভর্তি থাকে। কিন্তু এই মুখার্জিমশাই বিদেশে বিভুয়ে এমন দুরবস্থায় পড়েছেন যে ওঁকে শেষ পর্যন্ত আইনের বই বেচে খেতে হয়েছে। উনি নিশ্চয় কর্নেলের মতো চিরকুমার। তাই কর্নেলের প্রিয় পরিচারক ষষ্ঠীচরণের মতো এই ভোলাই তাঁর দেখাশোনা রান্নাবান্না কাজকর্ম করে।
কর্নেল যেন আমার মনের কথা আঁচ করেই হঠাৎ বললেন, এই ভদ্রলোক অ্যাডভোকেট ছিলেন। কিন্তু যদি ভাবো, পয়সা কামাতে পারেননি ভুল করবে। কারণ এত বড় একটা দোতলা বাড়ি করা সহজ কথা নয়। অথচ বাড়িটার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ভাড়া দিতেও পারতেন। দেননি। বাড়িটার ॥ অবস্থা– বলে উনি ছাদের দিকে টর্চের আলো ফেললেন। টালিগুলো ফাঁক হয় আছে। কড়িবর্গার অবস্থা শোচনীয়। যে-কোনও সময় ছাদ ধসে পড়তেই পারে।
শিউরে উঠলাম। এসব অলক্ষুণে কথা বলবেন না। কালা দেওয়ের গান থেকে সদ্য প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরেছি।
সেই মুহূর্তে ঝুরঝুর করে কোথায় বালি খসে পড়ল। কানের ভুল কি না কে জানে, মনে হল, ভোলার পায়ের শব্দ হল মাথার ওপর। বললাম, কর্নেল। এখানে আশ্রয় নেওয়ার চেয়ে দেখছি বৃষ্টিতে ভেজা নিরাপদ ছিল।
কর্নেল টর্চ নিভিয়ে বললেন, ওপরের ঘরে হাঁটাচলা করছে কেউ।
ভোলা ছাড়া আর কে?
কর্নেল চুপ করে থাকলেন। বাইরের দরজা দিয়ে বিদ্যুতের মুহুর্মুহু আলোয় জোর বৃষ্টি দেখতে পাচ্ছিলাম। প্যান্টশার্ট ভিজে চবচবে এবং এখন ঘরের ভেতরে ওম পাব কী, বড্ড শীত করছিল। একটু পরে আবার ঝুরঝুর করে কিছু ঝরে পড়ল ছাদ থেকে। চমকে উঠে বললাম, কর্নেল! এ ঘরে বসে থাকা বিপজ্জনক মনে হচ্ছে।
কর্নেলই বললেন, আর কোন ঘরে গিয়ে বসবে ভাবছ? ভেতরে তো আরও ঘর আছে। ভোলাকে ডাকুন।
আমার কথা শেষ হতেই ছাদে চাপা শব্দ হল এবং আবার একরাশ চুন সুরকি ঝরে পড়ল। এবার আমাদের সামনেই টেবিলের ওপর। ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
কর্নেল টর্চ ফেলে ছাদটা দেখে বললেন, হু। ওপরের ঘরে কেউ হাঁটাচলা করলেই এই অবস্থা হয়। টর্চের আলো তিনি টেবিলে এবং টেবিল থেকে মেঝেয় ফেললেন। দেখছ? কত গুড়ো চুনসুরকি ঝরে পড়ে সারাক্ষণ অথচ ভোলা মেঝে পরিষ্কার করে না।
কর্নেল! চলুন, ভেতরে যাই। দেখি কোনও নিরাপদ জায়গা আছে কি না।
হুঁ। থাকা তো উচিত।
তাহলে চলুন না! আমার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে।
জয়ন্ত! অস্বস্তি আমারও হচ্ছে। চলো!
বলে কর্নেল ভেতরের দরজা দিয়ে ঢুকলেন। ওঁর হাতে টর্চ জ্বলছিল। ওঁকে অনুসরণ করে গিয়ে দেখি, একটা বারান্দা এবং তার নীচে উঠোন জঙ্গল হয়ে আছে। বারান্দার শেষদিকে সিঁড়ি। সিঁড়ির কাছে পৌঁছে এক পলকের জন্য বিদ্যুতের আলো এবং বৃষ্টির মধ্যে আবছা একটা মূর্তি দেখতে পেলাম। বললাম, কে?
কর্নেল বললেন, কোথায় কে?
উঠোনের জঙ্গলে কাকে যেন দেখলাম। শিগগির আলো ফেলুন।
টর্চের আলোয় কাউকে দেখা গেল না। কর্নেল একটু হেসে বললেন, তুমি অকারণে ভয় পাচ্ছ জয়ন্ত!
আমার মনে এতক্ষণে সন্দেহ জাগল, এই বাড়িটা কোনও পোড়ো এবং ভুতুড়ে বাড়ি নয় তো? ভোলা কি মানুষ? ওর চেহারা যেন কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছিল না?
চাপা ভয়টা তাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু থেকেই গেল। সিঁড়িতে যখন কর্নেলের পিছনে উঠছি; তখন প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে, কেউ ঠাণ্ডাহিম হাতে আমার গলা টিপে ধরবে, কিংবা সিঁড়িটাই বেঙে পড়বে।
ওপরের জীর্ণ রেলিংঘেরা বারান্দায় পৌঁছে কর্নেল ডাকলেন, ভোলা!
একটা ঘরের দরজা খুলে গেল এবং আলো দেখতে পেলাম। ভোলা সাড়া দিল। বিষ্টি তো এখনও পড়ছে স্যার! বিষ্টির মধ্যে চলে যাবেন কেন?
কর্নেল বললেন, তোমার কর্তামশাইয়ের সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।
ভোলা আস্তে বলল, তা আসুন। কিন্তু উনি ঘুমোচ্ছেন। ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি।