বলেছি। তাই শুনেই উনি–যাক্। এখন এসব কথা নয়। যা অবস্থা দেখছি, যানবাহন পাব না। পায়ে হেঁটে যেতে হবে।
বাংলোবাড়িটা কোথায়? কত দূরে?
এখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার হবে। শচীনবাবুর সেই বাড়ির উল্টোদিকে কিছুটা দূরে একটা টিলার মাথায়। বাড়িটার নাম হিলটপ। তরুণবাবু জিদ করে আস্ত একটা পাহাড় কিনে ফেলেছিলেন।
সেই কনকনে ঠাণ্ডা এবং কুয়াশায় বাঁদিকে নতুন টাউনশিপ এবং বাজার এলাকা ছাড়িয়ে আমরা যে রাস্তায় মোড় নিলাম, সেটাই বরমডিহি-জাহানাবাদ রোড। সৌভাগ্যক্রমে একটা খালি ট্রাক পাওয়া গেল। ট্রাকটা একটা কাঠগোলা থেকে সবে স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় উঠেছিল। ট্রাক ড্রাইভাররাও যে এই মরশুমে বেশ কামিয়ে নেয়, তা বুঝলাম। পঞ্চাশ টাকা হেঁকেছিল। তিরিশে রফা হল। তখন তিরিশ টাকা অনেক টাকা!
কিন্তু কী আর করা যাবে? কর্নেল যা পারেন, আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। মিলিটারির লোক। তার ওপর এই বয়সেও গায়ে সাংঘাতিক জোর। এদিকে ওইটুকু হেঁটেই আমি ভিজে বেড়ালছানা হয়ে গেছি।
কুয়াশার মধ্যে হেডলাইট জ্বেলে ট্রাকটা সাবধানে যাচ্ছিল। প্রায় আধঘণ্টা পরে ড্রাইভার বলল, হিলটপ বাংলো বোলা? উতারিয়ে।
টাকা মিটিয়ে দুজনে নামলাম। ততক্ষণে কুয়াশা কিছুটা কমেছে। সূর্যের চেহারা বিবর্ণ হলুদ থালার মতো এবং মাঝে মাঝে কুয়াশার প্রবাহ চলেছে। ট্রাকটা চলে গেল। কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন জয়ন্ত! তোমার দুর্ভাগ্য! হাঁটতেই হবে।
কেন?
মনে হচ্ছে, আধ কিলোমিটার এগিয়ে এসেছি। হু! ওই তো মুনলেক যাওয়ার রাস্তা!
খাপ্পা হয়ে বললাম, ট্রাক ড্রাইভারটা তো মহা পাজি!
নাহ। ওর দোষ নেই। আমিও তো কুয়াশায় কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। চলো, মুনলেক রোড দিয়ে ঘুরে শর্টকাট করি। ওই রাস্তার উত্তরে হিলটপ বাংলো। সেবার বাইনোকুলারে দূর থেকে দেখেছিলাম। কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন, এস। জগিং করা যাক্। তা হলে ঠাণ্ডাটা কেটে যাবে। কাম অন!
বলে সত্যিই উনি জগিং শুরু করলেন। অগত্যা আমিও শুরু করলাম। কিন্তু সুটকেস হাতে জগিং বা দৌড়ব্যায়াম সহজ নয়। তাতে পাথর, ঝোপঝাড়, উঁচুউঁচু গাছের জঙ্গল। একবার হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম। দ্বিতীয়বার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। কর্নেল আমাকে টেনে ওঠালেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়াশা মোটামুটি কেটে গেল। হিলটপ বাংলো কর্নেলের বাইনোকুলারে ধরা পড়ল। তারপর কী করে যে চড়াই বেয়ে বাংলোর গেটে পৌঁছুলাম কে জানে! কর্নেল হয়তো একটা আস্ত চুম্বক।
কেয়ারটেকার আমাদের দেখে দৌড়ে এলেন। আপনি কি কর্নেল সায়েব? নমস্কার স্যার। সায়েব ট্রাঙ্কল করেছিলেন ওঁর লোকাল ব্রাঞ্চ অফিসে। সেখান থেকে কাল সন্ধ্যায় আমাকে খবর দিয়ে গেছে। কিন্তু ওখান থেকে স্টেশনে গাড়ি পাঠানোর কথা। যায়নি গাডি? কী আশচর্য! বৈজু! বৈজু! ইধার আও।
একজন লোক দৌড়ে এল। কেয়ারটেকারের নির্দেশে সে আমাদের সুটকেস দুটো নিয়ে গেল। কর্নেল সহাস্যে বললেন, গাড়ি নিশ্চয় গিয়েছিল। তবে গাড়ি সম্ভবত সাদা দাড়ি খুঁজছিল এবং দাড়ির দর্শন পায়নি। কারণ তা ঢাকা ছিল।
কেয়ারটেকার হেসে ফেললেন।
সুন্দর সাজানো একটা ঘরে আমাদের নিয়ে গিয়ে তিনি রুম হিটার চালিয়ে ঘর গরমের ব্যবস্থা করলেন। কর্নেল বললেন, আপনিই নন্দবাবু?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার নাম নন্দকুমার রায়। সায়েব কিংবা তাঁর গেস্ট এলে আমি আগাম চলে আসি। নৈলে বৈজই সব দেখাশোনা করে। বেজু জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবেতেই এক্সপার্ট। চায়ের ব্যবস্থা করে আসি।
কফি পেলে ভাল হয়। আমি কিন্তু কফিরই ভক্ত।
নন্দবাবু হাসলেন। কফিও আছে। কোনও অসুবিধা নেই স্যার! সায়েবও আসবেন বলেছেন। তাই সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
নন্দবাবু চলে গেলে বললাম, আপনি ভবিষ্যতে আর দাড়ি ঢাকবেন না। ওঃ! আপনি দাড়ি না ঢাকলে এই কষ্টটা পেতাম না।
ডার্লিং! কথায় আছে না কেষ্ট পেতে হলে কষ্ট করতে হয়?
কী কেষ্ট পেলেন শুনি?
কর্নেল চোখে হেসে বললেন, শুধু কেষ্ট নয়, তার সঙ্গিনী রাধাকেও।
অ্যাঁ?
চেপে যাও, ডার্লিং! স্পিকটি নট। বলে ওভারকোট এবং হনুমানটুপি খুলে ফেললেন কর্নেল। চাপা স্বরে ফের বললেন, ট্রাক ড্রাইভারকে বখশিস দেওয়া উচিত। আমাকে ঠিক জায়গায় সে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।
নন্দবাবু এলেন। কফি এসে যাচ্ছে। ব্রেকফাস্ট কখন খাবেন স্যার?
ঘড়ি দেখে কর্নেল বললেন, এখন সাড়ে আটটা। ন-টায় খাব বরং।
বৈজু আছে। কোনও অসুবিধে হবে না। আমি একবার বাড়ি ঘুরে বাজার টাজার করে আসছি।
আপনি কি বরমডিহির বাসিন্দা?
আজ্ঞে তিনপুরুষের বাসিন্দা। বলে নন্দবাবু ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন। আমি বাথরুমে যাচ্ছিলাম। লক্ষ্য করলাম, নন্দবাবু সাইকেল নিয়ে লনে হাঁটছেন। বোঝা গেল, ভদ্রলোক যদিও কেয়ারটেকার, এই বাংলোয় আসেন কদাচিৎ। সম্ভবত বৈজুই কার্যত কেয়ারটেকারের সব দায়িত্ব পালন করে।
বাথরুম থেকে ফিরে দেখি, টেবিলে কাপ, ট্রেতে কফির পট, দুধ, চিনি এবং দুটো মস্ত পেয়ালা। প্লেট ভর্তি নানারকম স্ন্যাক্সও আছে। রুম হিটারের কাছাকাছি বসে আরামে কফি খেতে খেতে বললাম, দা হলে দৈবাৎ বিগ সন্ধান পেয়ে গেছেন?
কর্নেল চোখ কটমট করে তাকালেন।
বললাম, সরি! স্পিকটি নট।