কর্নেল চোখ বুজেই বললেন, ডাকবাংলো পৌঁছুতে আমাদের সময় লেগেছিল। সেই সময়ের মধ্যে বডি সরানো এবং রক্ত ধুয়ে ফেলা সহজ ছিল। বিশেষ করে বৃষ্টি হচ্ছিল এবং ছাদ ছিল ফাটা। তাই জল দেখে পুলিসের সন্দেহ হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া তখন রাত্রিকাল।
পুলিশেরও লক্ষ্য ছিল একটা লাশ। তাই লাশ দেখতে না পেয়ে খাপ্পা হয়ে চলে যায়।
ঠিক বলেছ। পুলিশ আমাকে ফোনে বলছিল টালি এবং সুরকি ধোয়া জল দেখে আমি নাকি রক্ত ভেরেছি। ওই বাড়িটা নাকি ভুতুড়ে। বলে কর্নেল চোখ খুলে একটু হাসলেন। পুলিশের আইনে ভূত বলে কিছু নেই। কিন্তু পুলিশও তো মানুষ। মানুষের মনে ভূতপ্রেতে বিশ্বাস থাকা স্বাভাবিক। চিন্তা করো নির্জন এলাকায় একটা পোড়ো জরাজীর্ণ বাড়ি। এমন বাড়ি সম্পর্কে ভতে ছড়াতেই পারে।
কর্নেল! হরিবাবুও নাকি একই দৃশ্য দেখেছিলেন!
হুঁ। বলে কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। একটু পরে বললেন মিঃ এস. এল. মুখার্জির সঙ্গে কথা বলতে চাই।… বলুন, কর্নেল জীs. সরকার কথা বলবেন। জরুরি কথা। বলে কর্নেল কাঁধে টেলিফোন আটকে কে নিভে যাওয়া চুরুট ধরালেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন মিঃ মুখার্জি? আপনাকে একটু বিরক্ত করছি।… আপনি গৃহদেবতা ফেরত চান… না, না। এখনও আমি সন্ধান পাইনি। কিন্তু আপনার সহযোগিতা চাইছি। …হ্যাঁ। প্লিজ আমার প্রশ্নের জবাব দিন। আশা করি, সঠিক জবাব পাব। আচ্ছা, আপনি কি হরিবাবুকে বিগ্রহ উদ্ধার করে দিতে বলেছিলেন? বলেননি?.হ্যাঁ, হ্যাঁ। তা ঠিক। …অ্যাঁ? প্লিজ রিপিট। …অনুতপ্ত হতেই পারেন। স্বাভাবিক। কিন্তু এ কথাটা আপনি কি ইচ্ছে করেই আমাকে আমাকে জানানি? …হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনার কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ার কারণ ছিল না। …ঠিক। আচ্ছা মিঃ মুখার্জি, আর একটা প্রশ্ন। শ্যামবাবু– মানে হরিবাবুর সেই আত্মীয় খুন হওয়ার কথা আপনি জানেন? …জানেন না? হ্যাঁ। ওঁর রক্তাক্ত লাশই আমি দেখেছিলাম… জানেন না তাহলে? রাখছি।
বলে কর্নেল টেলিফোন রাখলেন। উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। বললাম কী বললেন?
কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, বরমডিহি।
তার মানে?
আমরা আজ রাতের ট্রেনে বরমডিহি যাচ্ছি। শীতটা ওখানে বড্ড বেশি। গরম জামাকাপড় সঙ্গে নেবে। চিন্তা কোরো না! দুপুরে পূর্বরেলের পি. আর. ও. কে ফোন করে ফার্স্টক্লাসে দুটো বাৰ্থ রাখতে বলেছি। দশটা পঁয়ত্রিশে ট্রেন ছাড়ার কথা। তুমি এখনই গিয়ে রেডি হও। আমি তোমাকে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে যাব। কর্নেল মিটিমিটি হাসলেন। আবার ভূত দেখতে পাবে ডার্লিং! পোভড়া বাড়ির ভূত।
০৭. কর্নেলের হেঁয়ালি
হাড়কাঁপানো শীতের সকালে বরমডিহি রেলস্টেশনে যখন ট্রেন থেকে নামলাম, তখনও চারদিকে গাঢ় কুয়াশা। কয়েক হাত দূরে কিছু দেখা যায় না। কর্নেল হনুমানটুপি পরেছেন। তাই ওঁর দাড়ি ঢেকে গেছে এবং মুখের খানিকটা মাত্র দেখা যাচ্ছিল। সম্ভবত এখন এটাই ওঁর ছদ্মবেশ! একটা ওভারকোটও চাপিয়েছেন। গায়ে। প্রকাণ্ড শরীর আরও প্রকাণ্ড দেখাচ্ছে। পিঠে আটকানো বোঁচকা এবং হাতে সুটকেস। গলায় ঝুলন্ত বাইনোকুলার ওভারকোটের ভেতর লুকিয়ে আছে।
আমার মাথায় টুপি এবং আষ্টেপিষ্টে জড়ানো মাফলার। পুরু জ্যাকেটের ভেতরও শীতের ঠাণ্ডা হিম থাবা টের পাচ্ছি। কর্নেলের পরামর্শে পশমের দস্তানা পরেছি। হাতে একটা হাল্কা সুটকেস।
বরমডিহি একটা হিলস্টেশন। পাহাড় দুভাগ করে রেললাইন চলে গেছে। পাড়ের গায়ে জঙ্গল কুয়াশায় ঢাকা। অক্টোবরে আমরা এখানকার নিসর্গের অন্যরূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ডিসেম্বরের সকালে এখানকার নিসর্গের অন্য রূপ দেখে আমি ভড়কে গেলাম। এর চেয়ে দার্জিলিং-কালিম্পং অনেক আরামদায়ক, যদিও সেখানে বরফ পড়ে। এখানে বরফ পড়ে না। কিন্তু এ কী বিচ্ছিরি ঠাণ্ডা!
কিন্তু এই সাংঘাতিক ঠাণ্ডার মধ্যেও কী ভিড়! কর্নেল হনুমানটুপির আড়াল থেকে বললেন, শীতে মুনলেক ট্যুরিস্টদের বড় আকর্ষণ। এ সময় কালো দৈত্যের উপদ্রব হয় না। তবে বেশিরভাগই বাঙালি। পিকনিক করতে আসে আশেপাশের শিল্পাঞ্চল থেকে। সব হোটেল, ট্যুরিস্ট লজ, সরকারি বাংলো গিজগিজ করে। কলকাতার বাবুদের বাড়িগুলো ভাড়া দিয়ে কেয়ারটেকাররা এ সময় প্রচুর কামিয়ে নেয়।
উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, তা হলে এবার আমরা উঠব কোথায়?
তরুণবাবুর বাংলোবাড়িতে।
তরুণবাবু? কোন তরুণবাবু?
তোমাকে যখন তরুণবাবু বলছি, তখন তোমার বোঝা উচিত এখন একজন তরুণবাবুই আছেন, যাঁকে তুমিও চেনো।
অবাক হয়ে বললাম, শচীনবাবুর ভাই তরুণবাবু? ওঁর এখানে বাংলোবাড়ি আছে নাকি?
থাকা স্বাভাবিক। বৈমাত্রেয় দাদা ওঁকে পৈতৃক বাড়িতে ঢুকতে দেননি। কাজেই বিত্তবান ছোটভাই ক্ষোভে দুঃখে এবং জিদ করেই এখানে সুদৃশ্য বাংলোবাড়ি তৈরি করেছেন।
কিন্তু তরুণবাবুর সঙ্গে আপনার এ ব্যাপারে কখন কথা হল?
কাল দুপুরে তুমি যখন ঘুমোচ্ছিলে, তখন টেলিফোনে কথা হয়েছে। কর্নেল হনুমানটুপির আড়ালে হাসলেন এবং চোখে সেই কৌতুকের হাসি জ্বলজ্বল করে উঠল। দাদাকে চিট করার জন্য তরুণবাবু সব সময় তৈরি। কাজেই আমি সেই সুযোগটা নিয়েছি আর কী! এবার দেখা যাক, ঝুলির ভেতর থেকে কার বেড়াল বের হয়।
আপনি ওঁকেও কি বলেছেন শ্যামবাবুরই রক্তাক্ত লাশ দেখেছিলেন?