এদিনও কর্নেলের বাড়ি লাঞ্চ খেয়ে ড্রয়িং রুমের ডিভানে লম্বা হয়েছিলাম। কর্নেল কোথায়-কোথায় টেলিফোন করছিলেন এবং চাপা গলায় কথা বলছিলেন, তারপর হঠাৎ ডাকলেন, উঠে পড়ো জয়ন্ত! বেরুনো যাক।
ভাতঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বললাম, ওঃ কর্নেল! খালি ছুটোছুটি আর কথাবার্তা!
কর্নেল হাসলেন। ছুটোছুটি না করে উপায় কী? আমরা ভুতুড়ে খুনখারাপি দেখে এসেছি। হরিবাবুও একই দৃশ্য দেখেছিলেন। ছুটোছুটি করে খুনী ভূতটাকে তো ধরতে হবে। আর কথাবার্তার কথা বলছ? কথা বলতে বলতে অনেক কথা বেরিয়ে আসে। আসলে আমরা জানি না যে কী জানি। তাই অনর্গল কথা বলতে হয়। জানা কথাটা এভাবেই মুখ দিয়ে নিজের অজান্তে চলে আসে। এই দুদিনে পুরো একটা ইতিহাস বেরিয়ে এল এবং একজোড়া বিগ্রহ!
কিন্তু এবার বেরুবেন কোথায়? নতুন কোনও সূত্র পেয়েছেন নাকি?
নাহ্। বেচারা হরিবাবুর খবর নেওয়া দরকার। কোর্টে যাননি। ওঁর পেছনে শত্রু লেগেছিল। নোটবইটা পেয়েও যদি সে খুশি না হয়? কিংবা যদি সে দেখে যে এটা সেই নোটবই নয়? হরিবাবুর কী দশা হবে ভাবো!
বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। সত্যিই তো! যদি ওটাই সেই কালো নোটবই না হয়?…
পাইকপাড়ার সেই ঠিকানায় কালকের চেয়ে আজ আগেই পৌঁছুলাম। ঝলমলে মিঠে রোদ্দুর খেলছে। মশা নেই। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে হরিবাবুর ঘরের সামনে কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। দরজায় তালা ঝুলছে।
পাশের ঘরের এক ভদ্রমহিলা আমাদের দেখতে পেয়ে বললেন, হরিদার কাছে এসেছেন আপনারা? সে তো কাল সন্ধ্যায় দেশের বাড়িতে গেছে। বউদি নাকি খুব অসুখ। আমাকে বলে গেছে, কেউ তার খোঁজে এলে যেন জানিয়ে দিই।
কর্নেল বললেন, কবে ফিরবেন কিছু বলে গেছেন?
ঠিক নেই। অসুখবিসুখের ব্যাপার।
ওঁর দেশের ঠিকানা জানেন?
না তো! মেদিনীপুরে কোন গ্রামে যেন।
কর্নেল একটু কাচুমাচু মুখ করে বললেন, একটা জরুরি কাগজ টাইপ করতে দিয়েছিলাম। বড় সমস্যায় পড়া গেল দেখছি। আচ্ছা, হরিবাবুর কোনও অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকা উচিত। তার হাতেও আমার কাগজটা দিয়ে যেতে পারেন। তেমন কেউ কি এ ঘরে ওঁর সঙ্গে থাকেন না?
ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে বললেন, এ ঘরে হরিদা একা থাকে।
ওঁর মামাতো ভাই শ্যামসুন্দরবাবু ওঁর সঙ্গে থাকেন শুনেছিলাম। তিনি–বলে কর্নেল ভদ্রমহিলাকে হাঠৎ জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কতদিন এখানে আছেন?
অনেকদিন। আপনি শ্যামবাবুর কথা বলেছেন? শ্যাম নামে একজন হরিদার কাছে থাকত। সে তো অনেক বছর আগের কথা। হরিদার কাছে শুনেছিলাম, লোকটা ভাল না। মানে, হরিদার টাকাকড়ি চুরি করে পালিয়েছিল। আমার কিন্তু লোকটাকে একেবারে পছন্দ হত না।
আচ্ছা চলি! বলে কর্নেল সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন।
নিচে নেমে বললাম, জাল ভোলা ওরফে হারাধন কাল সন্ধ্যায় বউয়ের অসুখ বলে দেশে চলে গেছে। এদিকে হরিবাবুও কাল সন্ধ্যায় বউয়ের অসুখ বলে দেশে চলে গেছেন। টাইমিংটা লক্ষ্য করুন কর্নেল! ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছে। দুজনেই হঠাৎ একই সঙ্গে গা-ঢাকা দিয়েছে যেন। কিন্তু কেন?
কর্নেল তুম্বো মুখে হাঁটছিলেন। আমার প্রশ্নের জবাবে কিছু বললেন না।
বললাম, অবশ্য নেহাত কাকতালীয় ঘটনাও হতে পারে। কারও বউয়ের অসুখ হতেই পারে। আবার অফিসের কর্মীরা বউয়ের অসুখের কথা না বললে ছুটি পায় না।…
ইলিয়ট রোডে তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল যথারীতি ষষ্ঠীকে কফির হুকুম দিয়েছিলেন। আজ সন্ধ্যায় শীতের ঈষৎ আমেজ পাওয়া যাচ্ছিল। কলকাতায় ডিসেম্বরের গোড়ায় শীতের চেহারা পুরো দেখা যায় না, যদিও বহু লোক গায়ে সোয়েটার-জ্যাকেট চড়ায়।
কফি খেতে খেতে কর্নেল হঠাৎ বললেন, দুই ভাইয়ের একভাই কোনও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আমার কাছে গোপন করছেন। শচীনবাবু কিংবা তরুণবাবু যে কোনও একজন। সেই গোপন কথাটা আমি জানতে পারলে এ রহস্য ফাঁস করা সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হল, ওঁরা কি ইচ্ছে করেই গোপন করছেন, নাকি ওঁরা জানেন না ওটা আমার কাছে মূল্যবান সূত্র হতে পারে?
জিজ্ঞেস করলাম, গোপন কথাটা কী হতে পারে বলে আপনার ধারণা?
শ্যামবাবুর হত্যাকাণ্ড।
চমকে উঠে বললাম, শ্যামবাবুকে খুন করা হয়েছে বলতে চান?
তুমিও দেখেছ জয়ন্ত।
অ্যাঁ? আমি দেখেছি? কবে? কোথায়?
২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় ঝড়বৃষ্টির সময় বরমডিহির সন্ধ্যানীড়ে।
কর্নেল! সেই রক্তাক্ত বডিটা শ্যামবাবুর নাকি?
হ্যাঁ। টর্চের আলোয় মুখটা দেখেছিলাম। তুমি তো জানো, যে মুখ একবার দেখি, তা আমি ভুলি না। তরুণবাবুর অফিসের গ্রুপ ফোটো থেকে শ্যামবাবুর যে ছবিটা তুলেছি, তা নিঃসন্দেহে সন্ধ্যানীড়ের দোতলার সেই ঘরে টর্চের আলোয় দেখা নিহত লোকটিরই ছবি।
শুকনো গলায় বললাম, হরিবাবুকে লেখা উড়ো চিঠিতে শ্যামবাবুকে খতম করে পুঁতে ফেলার করা ছিল বটে! সেখানে আমরা জাল ভোলা অর্থাৎ হারাধনকে দেখেছিলাম। তা হলে হারাধন…
আমার কথার উপর কর্নেল বললেন, হারাধন অন্যতম খুনী।
আর তক্তাপোসে নোংরা বিছানায় অসুস্থ শচীনবাবু সেজে যে লোকটা শুয়েছিল, সে-ও খুনী।
হ্যাঁ। আমি টর্চের আলো তার মুখে ফেলার আগেই হারাধন তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল।
কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। আমি দৃশ্যটা স্মরণ করছিলাম। একটু পরে বললাম, আপনার ফোন পেয়ে পুলিশ সেখানে গিয়ে কিছু দেখতে পায়নি। অন্তত রক্ত চোখে পড়া উচিত ছিল?