তরুণবাবু সহাস্যে বললেন, আবার কোথাও ডেডবডি দেখেছেন নাকি কর্নেল সরকার?
কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, না। আমি একটা কথা জানতে এসেছি।
আর কী কথা?
আপনাদের বংশের বিগ্রহ রাধাকৃষ্ণ সম্পর্কে।
আমাকে তো দাদা তাঁর বংশের লোক বলে স্বীকারই করেন না। তরুণবাবুর মুখে হঠাৎ বিকৃতি ফুটে উঠল। আপনাকে বলেছিলাম, ছাত্রাবস্থায় আমাকে এবং মাকে ওই ভদ্রলোক আমার পৈতৃক বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অনেক লড়াই করে আমি এই অবস্থায় পৌঁছেছি। আপনাকে এ-ও বলেছিলাম, প্রকাশ্য আদালতে উনি আমার মাকে আমার বাবার বিবাহিতা স্ত্রী বলে মানতে চাননি।
প্লিজ মিঃ মুখার্জি! আমি আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতে আসিনি। আমি ওই বিগ্রহ সম্পর্কে আপনার কাছে কিছু তথ্য জানতে এসেছি। কারণ এ ব্যাপারে আপনি আমাকে কিছু জানাননি।
আপনি জিজ্ঞেস করেননি, তাই বলিনি।
এখন জিজ্ঞেস করছি।
তরুণবাবু গুম হয়ে বললেন, কফি খাবেন, না চা?
কিছু না। আপনি বিগ্রহ সম্পর্কে বলুন।
হরি গাঙ্গুলি নামে দাদার একজন ক্লার্ক ছিল। সে—
তরুণবাবু থেমে গেলেন। কর্নেল বললেন, বলুন।
সে–গোপন করতে চাই না, আমাকে দাদার লিগ্যাল লড়াইয়ের প্ল্যান সম্পর্কে আগাম খবর পাচার করত। তাকে টাকা দিতাম। তার এক আত্মীয়কে আমার ফার্মে চাকরিও দিয়েছিলাম।
শ্যামসুন্দর নাম ছিল তার?
আপনি জানেন দেখছি!
জেনেছি। আপনি বলুন।
অনেক বছর আগের কথা। হঠাৎ একদিন কাগজে পড়লাম ভবানীপুরে আমাদের পৈতৃক বাড়ি থেকে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ চুরি গেছে। মা তখন বেঁচে নেই। আমি বিচলিত হয়ে উঠেছিলাম। ওই বিগ্রহ নাকি স্বয়ং শ্রীচৈতন্যের আশীর্বাদ–
শুনেছি। আপনার দাদার সঙ্গে আমি দেখা করেই আপনার কাছে এসেছি।
তো কদিন পরে হরি এসে একটা সাংঘাতিক কথা বলল। দাদা নাকি নিজেই বিগ্রহ চুরি করে আমাকে ফাঁসানোর জন্য তার হাত দিয়ে আমার বাড়িতে পাচার করতে চেয়েছিলেন। সেই বিগ্রহ হরির ঘর থেকে চুরি গেছে। হরির বাসাতেই শ্যামসুন্দর থাকত। সে নাকি পালিয়েছে বিগ্রহ নিয়ে।
শ্যামবাবু হরিবাবুর বাসায় থাকতেন?
হ্যাঁ। শ্যাম সেখানে থেকেই আমার অফিসে কাজ করতে আসত। তবে এর সত্যমিথ্যা জানি না।
হরিবাবু আমাকে অন্য কথা বলেছেন। শ্যামবাবু নাকি বাউণ্ডুলে ছিলেন এবং মাঝে মাঝে ওঁর বাসায় হাজির হতেন!
তরুণবাবু রুষ্টমুখে বললেন, হরি বড্ড পাচালো স্বভাবের লোক। হবে না কেন? হাড়ে-হাড়ে প্যাঁচালো বুদ্ধির এক আইনকারবারির সঙ্গদোষে সেও ওইরকম হয়ে পড়েছিল।
তারপর কী হল বলুন?
ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। শ্যাম তারপর থেকে উধাও। আমার অফিসে আসছে না দেখে বুঝলাম হরি ঠিক বলেছে। তারপর এতগুলো বছর চলে গেল। আর শ্যামের পাত্তা নেই।
হরিবাবু আপনার কাছে আসেন?
নাহ্। তার সম্পর্কে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। এলেও তার সঙ্গে দেখা করব না। বাই-দাবাই, এখন কোথায় আছে সে? কী করে?
পাইকপাড়ায় সেই বাসায় আছেন। আলিপুর কোর্ট চত্বরে স্বাধীনভাবে টাইপিংয়ের কাজ করেন।
তরুণবাবু আস্তে বললেন, কিন্তু আপনি আমাদের ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড কেন?
আপনাকে বলেছিলাম বরমডিহিতে আপনাদের বাড়িতে—
হ্যাঁ। কিন্তু বাড়িটার ভুতুড়ে বলে বদনাম আছে। আমি যে মামলা লড়ছি, তা নিছক ওই পোডড়া বাড়ির জন্য নয়। আমার মায়ের সম্মান রক্ষার জন্য। এটা আপনার বোঝা উচিত
বুঝি মিঃ মুখার্জি! আসলে আমি আগে ওই ভৌতিক রহস্য সম্পর্কে আগ্রহী ছিলাম। এবার আমি বিগ্রহ চুরি এবং শ্যামবাবুর অন্তর্ধান সম্পর্কে আগ্রহী। আমার ধারণা, এই ঘটনাগুলোর মধ্যে যোগসূত্র আছে।
তরুণবাবু ঘড়ি দেখে বললেন, ওয়েল, কর্নেল সরকার। আমার সহযোগিতা পাবেন। বিগ্রহ উদ্ধার করলে আমি আপনাকে—
হাত তুলে কর্নেল বললেন, পুরস্কৃত করবেন তো? না মিঃ মুখার্জি! আমার এই এক স্বভাব। রহস্য ফাঁস করা আমার হবি। যাই হোক, শ্যামবাবু আপনার কর্মচারী ছিলেন। তার কোনও ছবি আপনার অফিসে কি আছে?
থাকা সম্ভব। জাস্ট আ মিনিট। বলে উনি টেবিলের সুইচ টিপে বেয়ারাকে ডাকলেন। সে এসে সেলাম দিলে, বললেন, অবনীবাবুকে ডাকো।
একটু পরে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক চেম্বারে ঢুকে আড়ষ্টভাবে দাঁড়ালেন। তরুণবাবু বললেন, আচ্ছা অবনীবাবু! সেই শ্যামসুন্দর–আই মিন, যে ক্লার্ক নিপাত্তা হয়ে গিয়েছিল–
অবনীবাবু বললেন, শ্যামসুন্দর ভট্টাচার্যের কথা বলছে কি স্যার? হ্যাঁ। তার কোনও ছবি অফিসে আছে? থাকা তো উচিত। পার্সোনেল ডিপার্টমেন্টের ফাঁইলে খুঁজলে নিশ্চয় পাবেন। তবে সাত-আট বছর আগের ফাইল ঘাঁটতে হবে। সময় লাগবে। তাই না?
স্যার! একটা গ্রুপ ফোটোতে শ্যামবাবুর ছবি আছে মনে হচ্ছে।
দেখুন তো! এখনই চাই কিন্তু। আমি বেরুব।
অনীবাবু বেরিয়ে গেলেন। তারপর দু-মিনিটের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড বাঁধানো গ্রুপ ফোটো ঝাড়তে ঝাড়তে ঘরে ঢুকলেন। বললেন, পেছনের সারিতে দাঁড়ানো বাঁ-দিকের থার্ড ম্যান স্যার!
ওঁকে দেখান। বলে তরুণবাবু কর্নেলের দিকে আঙুল তুললেন। কর্নেল ছবিটা দেখার পর বললেন, একটা অনুরোধ মিঃ মুখার্জি! এটা আমার এক রাত্রির জন্য দরকার। আপনি আগামীকালই অফিস খোলার সময় ফেরত পাবেন। কথা দিচ্ছি।
কী করবেন ওটা নিয়ে?
আমার ক্যামেরা এবং নিজস্ব ডার্করুম আছে। শ্যামবাবুর ছবিটা থেকে একটা পোট্রেট করে নেব।