হ্যাঁ। অ্যাডভোকেট শচীনবাবু আপনাকে বিগ্রহ তরুণবাবুর বাড়িতে কোথাও লুকিয়ে রেখে আসতে বলেছিলেন। কর্নেল হাসলেন। নানা। লুকোবার কিছু নেই। যা হবার তা হয়ে গেছে।
স্যার! শচীনবাবু আপনাকে তা-ই বলেছেন?
বলেছেন। আপনি কফি খেতে খেতে বলুন। উত্তেজিত হবেন না! হরিবাবু কফির পেয়ালা টেবিলে রেখে বললেন, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়। আর উলুখাগড়ার প্রাণ যায়, সেই অবস্থা। আমি স্যার অত রাত্রে ছোটবাবুর বাড়ি ঢোকার সাহস পাইনি। এইটুকু দুটো বিগ্রহ বেদিতে আটকানো। ব্যাগে ভরা ছিল। রাত্রে বাসায় নিয়ে গিয়ে রেখেছিলাম। দিনের বেলা কোনও এক ছলে ছোটবাবুর বাড়িতে রেখে আসার ইচ্ছে ছিল। সেই রাত্রে শ্যামা আমার বাসায় ছিল। বদমাস শ্যামা কী করে টের পেয়েছিল জানি না। ভোরবেলা বাথরুমে গেছি। তারপর এসে দেখি শ্যামা নেই। বিগ্রহও নেই।
কিন্তু শ্যামবাবুর নোটবইটা বিগ্রহের ছবির পেছনে পাওয়া গেল। এর ব্যাখ্যা কী?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না স্যার!
আপনি কফি খান। আপনার আর ভয় কিসের? নোটবই দিয়েছেন। হ্যাঁ, কফি খান।
হরিবাবু আড়ষ্ট হাতে কফির পেয়ালা তুলে নিলেন। তাঁকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল।
কর্নেল বললেন, আপনি সকালে গিয়ে শচীনবাবুকে ঘটনাটা জানিয়েছিলেন। তাই না?
আজ্ঞে। শুনেই উনি আমাকে চড়থাপ্পড় মেরে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পুলিশে দেবেন বলে শাসাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি আসল কথা ফাঁস করে দিতে পারি ভেবে অত দূর এগোননি।
আপনার নাকের বাঁ-পাশের জডুলটা কতদিন আগে অপারেশন করেছে?
হরিবাবু চমকে উঠলেন। জ-জডুল সার?
হ্যাঁ। জডুল। শচীনবাবু বলছিলেন, আপনার জডুল অপারেশন করাতে বলতেন। আপনি নাকি ভয়ে অপারেশন করাননি। আপনার সেই বরমডিহির গ্রুপ ফোটোতে জডুলটা দেখেছি। কবে অপারেশন করালেন?
হরিবাবুর নাকের বাঁ-পাশে একটুখানি ক্ষতচিহ্ন দেখতে পেলাম। কাল ওটা লক্ষ্যই করিনি।
হরিবাবু বললেন, বছরখানেক আগে স্যার! মরিয়া হয়ে অপারেশন করিয়েছি।
ভাল করেছে। বড় মোটা জড়ুল ছিল। তাই ছবিতে চোখে পড়েছিল।
হ্যাঁ স্যার! মাঝে মাঝে ফেঁড়ার মতো টনটন করত।
কফি খান। আর চিন্তা কী? বলে কর্নেল নিজের পেয়ালা শেষ করে চুরুট ধরালেন। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, শ্যামবাবুর নোটবইটা আমি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছি। নোটবইয়ে বিগ্রহ লুকিয়ে রাখার গোপন সূত্র ছিল। আমি তার অর্থ উদ্ধার করেছি।
হরিবাবু আবার চমকে উঠলেন। কোথায় লুকোনো আছে বুঝতে পেরেছেন?
হুঁউ। বরমডিহিতে শচীনবাবুর বাড়িতেই লুকোনো আছে।
হরিবাবু তাকিয়ে রইলেন। নিষ্পলক চাউনি।
কর্নেল বললেন, জয়ন্ত এবং আমি নোটবইয়ে লেখা ওয়ার্ডগেম থেকে সূত্র টের পেয়েছি। জয়ন্ত, তুমি ওঁকে বুঝিয়ে দাও সূত্রটা। তোমার সংখ্যাভিত্তিক হিসেবও দাও।
আমি কর্নেলের কথার লক্ষ্য কী বুঝতে পারছিলাম না। তবু কর্নেল য়ামার হাতে প্যাড গুঁজে দিলে আমি আগের মতো ইংরেজিতে শ্যামবাবুর গ্র্যাব রেয়ার আর্টস বেস্ট শব্দগুলো সাজালাম। তারপর সংখ্যাগুলোও সাজিয়ে ফেললাম। যোগ করে দেখালাম ১৬০ হচ্ছে।
এবার কর্নেল বললেন, শচীনবাবু বলছিলেন, বরমডিহিতে নাকি ওঁর বাড়ি দুইতলায় মোট ২০টা ঘর। ১৬০-কে ২০ দিয়ে ভাগ করলে ৮ হয়। ৮ নম্বর ঘরের মেঝেয় তাহলে বিগ্রহ পোঁতা আছে।
হরিবাবু শুকনো হাসি হাসলেন। আজ্ঞে আমি স্যার ওসব সাতে-পাঁচে নেই। শচীনবাবুদের বিগ্রহ। ওঁদের বলুন। উদ্ধার করে পুজো দিক। আমি উঠি স্যার। নমস্কার।
হরিবাবু চলে যাওয়ার পর বললাম, বেচারাকে খামোকা ভড়কে দেওয়ার কারণ কী? নিরীহ ছাপোষা মানুষ!
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, আমার থিওরি যাচাই করে নিলাম। শুধ। এটাই জানা গেল না, শ্যামবাবু নোটবইটা ওখানে রেখেছিলেন কেন? যদি বিগ্রহের সঙ্গে সম্পর্কই থাকবে, তা হলে–নাহ। মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
কোথায় বেরুবেন বলছিলেন যে?
বেরুব। বলে কর্নেল পোশাক বদলাতে ভেতরের ঘরে ঢুকে গেলেন।
০৫. হারাধনের অন্তর্ধান
যে সময়ের কথা বলছি, তখন খবরের কাগজের অফিস থেকে আমি কোনও গাড়ি পাইনি এবং কর্নেল তার লাল রঙের পুরনো ল্যান্ডরোভার গাড়িটিও বেচে দিয়েছেন। তাই কোথাও যেতে হলে ট্রাম বাস ট্যাক্সি দুজনেরই সম্বল। তবে আগেই বলেছি কর্নেলকে কোনও রহস্যময় কারণে কোনও ট্যাক্সি না বলে না।
ব্র্যাবোর্ন রোডে যেতে যেতে একখানে ট্যাক্সি থামিয়ে কর্নেল নামলেন। তখন বিকেল পৌনে পাঁচটা বাজে। শীতের শেষ বেলায় এখনই রাস্তার ধারে আলো জ্বলে উঠেছে। দোকানপাটেও আলো জ্বলেছে। কর্নেল মুখ তুলে সাইনবোর্ডে দেখে নিয়ে বললেন, পেয়ে গেছি। এস।
আগেই জিজ্ঞেস করেছি, আমরা কোথায় যাচ্ছি। কিন্তু কর্নেল শুধু বলেছেন, এস তো! এতক্ষণে একটা সাততলা বাড়ির সিঁড়িতে উঠে বিশাল দরজার পর লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল বললেন, তরুণ মুখার্জির কোম্পানির অফিসে যাচ্ছি।
পাঁচতলায় করুণাময়ী ট্রেডিং কোম্পানির অফিস। বেসরকারি বাণিজ্য সংস্থায় কর্মচারীদের দেখেছি ঘাড় গোঁজ করে কাজ করতে হয়। বাঁধা কাজের সময় বলে কিছু থাকে না। তখনও পুরোদমে কাজ চলেছে। কর্নেল একজন বেয়ারাকে তার নেমকার্ড দিলেন। একটু পরে তরুণবাবুর ঘরে আমাদের ডাক পড়ল।
বৈমাত্রেয় দাদার একেবারে উল্টো স্বভাবের মানুষ তরুণ মুখার্জি। বছর তিরিশ-বত্রিশ বয়স। ফিটফাট ধোপদুরস্ত পোশাক এবং স্মার্ট চেহারা। পরনে স্যুট-টাই। মুখে পাইপ। ইংরেজিতে সম্ভাষণ এবং করমর্দন করে আমাদের বসতে বললেন। দেখলাম কর্নেল তার পরিচিত।