গম্ভীর হয়ে বললাম, আমি কোনও প্রশ্ন করব না কিন্তু। আপনার নির্দেশ।
আমিই তোমার হয়ে প্রশ্ন তুলছি। ছেলেটি হরিবাবুকে কাকু বলে। তাকে হুমকি দেওয়া চিঠি সে লিখল কেন? এর উত্তর হল, চিঠিতে কাকেও সম্ভাষণ করা হয়নি। কাজেই চিঠিটা যে হরিবাবুকে লেখা হচ্ছে, ছেলেটি জানত না। প্রশ্ন উঠবে, ছেলেটি এমন চিঠি লিখতে রাজি হল কেন? না–ছেলেটি জানে কোর্টের পরিবেশে ক্রিমিন্যালরাও ঘোরাফেরা করে। দ্বিতীয়ত, ছেলেটির টাকার দরকার। ওই পরিবেশটাই টাকা রোজগারের নানা ধান্দা-সুযোগ সামনে এনে দেয়। সেই সুযোগ যারা ওখানে ঘোরাফেরা করে, তারা ছাড়ে না। ছেলেটিও ছাড়েনি।
এবার বললাম, ছেলেটি আপনার কেসে মূল্যবান সূত্র।
হ্যাঁ। তবে এখন এই সূত্রের দিকে আমি হাঁটছি না। কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চুরুট ধরালেন। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, তোমার প্রশ্ন ছিল, শচীন্দ্রলাল মুখার্জি নিজের বৈমাত্রেয় ভাইকে চুরির দায়ে ফাঁসানোর জন্য যে বিগ্রহ চুরি করেছিলেন, তা আমি জানলাম কী করে? বিগ্রহ চুরির কথা আমি জানতাম না। তা শোনার পর আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে ওঁর প্রতিক্রিয়া বুঝতে চেয়েছিলাম।
কী বুঝলেন?
ওঁর ক্ষতস্থানে আঘাত করেছি। চিন্তা করো জয়ন্ত! আফটার অল, আমি। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমার এই চেহারা এবং ব্যক্তিত্বনা, হেসো না, তুমি বাস্তবতার দিক থেকে চিন্তা করেযতই বদরাগী এবং দুদে আইনজীবী হোন কিংবা অভিজাতবংশীয় হোন, কোনও ভদ্রলোক ওই ভঙ্গিতে অভদ্রভাবে আমাকে বেরিয়ে যেতে বা দারোয়ান ডেকে বের করে দেওয়ার কথা তৎক্ষণাৎ মুখ দিয়ে উচ্চারণ করবেন না। তর্ক করতেন ক্রুদ্ধভাবে। কিংবা আমাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু আমি কথাটা শেষ না করতেই উনি হিংস্র হয়ে উঠলেন। তার মানে, আমার মুখোমুখি আর একমুহূর্ত বসে থাকার ক্ষমতা ওঁর ছিল না। আমি সাধারণ মানুষ হলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমি উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার ছিলাম। আমাকে–
হ্যাঁ। আপনার কথায় যুক্তি আছে।
এবার আমার থিওরি হল, শচীনবাবু বিগ্রহ নিজেই চুরি করে কোনও বিশ্বস্ত লোকের হাত দিয়ে তরুণবাবুর বাড়িতে পাচার করেই পুলিশে খবর দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বস্ত লোকটির হাত থেকে বিগ্রহ অন্য হাতে চলে যায়। কিংবা এমনও হতে পারে সেই লোকটিই বিগ্রহ আত্মসাৎ করে মিথ্যা কথা বলে শচীনবাবুকে। ক্রুদ্ধ শচীনবাবু তাকে বরখাস্ত করে তাড়িয়ে দেন।
হরিবাবু সেই বিশ্বস্ত লোক নন তো?
এক্ষেত্রে সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশ বলা চলে।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে হরিবাবুকে কেউ হুমকি দিয়ে শ্যামবাবুর নোটবই চাইছে। তার মানে, হরিবাবুর হাত থেকে শ্যামবাবু তা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছিলেন। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনও কারণে বেচতে পারেননি। লুকিয়ে রেখেছেন।
কর্নেল বললেন, হুঁ, বলে যাও!
তাহলে নোটবইয়ের ওয়ার্ডগেমে এমন কোনও সংকেত আছে, যা থেকে শ্যামবাবুর লুকিয়ে রাখা বিগ্রহের খোঁজ মিলবে। এবার কিন্তু তৃতীয় একটি পার্টি এসে যাচ্ছে।
আসছে বটে! কর্নেল হঠাৎ হেসে উঠলেন। ওয়ার্ডগেম ছেড়ে এখন আমরা থিওরিগেম বা তত্ত্বক্রীড়ায় রত হয়েছি। বাজে জল্পনা ডার্লিং, জল্পনা! বলে হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী! আমরা খেতে বসব।
ষষ্ঠী পর্দার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে বলল, সব রেডি বাবামশাই!…
খাওয়ার পর ভাতঘুম আমার বহু বছরের অভ্যাস। ডিভানে লম্বা হয়েছিলাম। কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে একটা গাদা বইয়ের পাতায় মনোনিবেশ করেছিলেন। কতক্ষণ পরে কর্নেলের ডাকে উঠে বসলাম। সাড়ে তিনটে বাজে। শীতের দিনে সাড়ে তিনটে মানে বিকেল। উঠে পড়ো। গরম কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নাও। একটু পরে বেরুব।
ষষ্ঠী কফির ট্রে রেখে গিয়েছিল। কর্নেল কফি তৈরি করে আমাকে দিলেন। নিজেরটা তৈরি করে চুমুক দিয়ে বললেন, বরমডিহিতে দেখা সেই তুর্কি ঘোড়সওয়ার সম্পর্কে কিছু তথ্য পেলাম।
সেই অলক্ষুণে প্রজাপতিটা?
অলক্ষুণে কী বলছ ডার্লিং! মধ্যএশিয়ার এই প্রজাতির প্রজাপতি এদেশে আমদানি করেছিলেন স্বয়ং মুগল বাদশাহ্ জাহাঙ্গির। তার একটা চিড়িয়াখানা ছিল। ফুল বাগিচায় ওই প্রজাপতি–
কর্নেলের কথা শেষ হল না। ডোরবেল বাজল। একটু পরে ষষ্ঠীর পাশ কাটিয়ে হরিবাবু ঘরে ঢুকলেন। ধপাস করে সোফার কোনায় বসে ফোঁস করে শাস ফেলে বললেন, নিয়ে গেল স্যার! ওঃ! কী বাঁচা যে বাঁচলাম। আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে আজ সকাল-সকাল চলে এলাম কাজ ছেড়ে।
কর্নেল বললেন, নোটবইটা?
আজ্ঞে! লোকটার চেহারা স্যার একবারে মস্তানমার্কা। এন বি এনেছ বলমাত্র হাতে তুলে দিলাম। চলে গেল। সাহস করে মুখ তুলে তাকাতে পারিনি। পেছনটা দেখেছি। ওঃ! কী বাঁচা বাঁচলাম ঠাকুরই জানেন!
কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! একটা পেয়ালা দিয়ে যা। গেস্ট এসেছেন। একটুখানি খান হরিবাবু! উত্তেজনা দূর হবে। নার্ভ চাঙ্গা হবে।
হরিবাবু রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। ষষ্ঠী একটা পেয়ালা দিয়ে গেল। কর্নেল পট থেকে কফি ঢেলে দুধ চিনি মিশিয়ে ওঁর হাতে তুলে দিলেন। হরিবাবু চুমুক দিয়ে বললেন, আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব স্যার! আচ্ছা হরিবাবু, রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ আপনার হাতছাড়া হয়েছিল কীভাবে?
হরিবাবু চমকে উঠলেন। গলায় কফি আটকে কাশতে শুরু করলেন। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছিল। সামলে নিয়ে বললেন, বি-বিগ্রহ স্যার?।