শচীনবাবু ভুরু কুঁচকে তাকালেন কর্নেলের দিকে। আপনি তো নেচারিস্ট। আপনার কার্ডে লেখা আছে কথাটা। তা আপনি ভেতর-ভেতর গোয়েন্দগিরিও করেন বলে সন্দেহ হচ্ছে?
না মিঃ মুখার্জি। আমি মাঝে মাঝে কোনও রহস্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেলে সেই রহস্য ফাঁস করতে উঠে পড়ে লাগি। আমার এ-ও একটা হবি বলতে পারেন।
বিগ্রহ চুরিতে রহস্য কোথায় মশাই? স্রেফ চুরি। ওই তরুণের কীর্তি!
আপনার বরমডিহির বাড়িতে যে ঘটনার কথা বলেছিলাম,আমার ধারণা তার সঙ্গে আপনার বিগ্রহ চুরির যোগসূত্র আছে।
অ্যাঁ! বলেন কী?
আপনি আমাকে এবার এই প্রশ্নের উত্তর দিন।
বলুন!
বিগ্রহ কি আপনি বৈমাত্রেয় ভাই তরুণকে ফাঁসানোর জন্য নিজেই চরি করে–
আইনজীবী ফ্যাঁসফেঁসে গলায় আর্তনাদের সুরে চেঁচিয়ে উঠলেন, বেরিয়ে যান আপনারা! গেট আউট ফ্রম মাই হাউস! বেরিয়ে যান বলছি! নইলে দারোয়ান ডেকে বের করে দেব।
কর্নেল তুম্বো মুখে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। আমি যে ওঁকে অনুসরণ করলাম তা বলা নিষ্প্রয়োজন।…
০৪. জড়ুল এবং বিগ্রহ
রাস্তায় গিয়ে বললাম, হঠাৎ উঁকিল ভদ্রলোককে ওই অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন কেন?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, গ্র্যাব রেয়ার আর্টস্ বেস্ট।
ভ্যাট! খালি হেঁয়ালি করা অভ্যাস আপনার।
ওয়ার্ডগেম ডার্লিং, ওয়ার্ডগেম!
কথা বললে আরও হেঁয়ালি বাড়বে। তাই চুপ করে গেলাম। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্যাক্সির কাছে গিয়ে কর্নেল বললেন, আলিপুর কোর্ট। যাবেন নাকি?
ট্যাক্সি ড্রাইভাররা, বরাবর দেখে আসছি, কর্নেলের কথায় না করে না। পাদরিসুলভ চেহারার জন্য, কিংবা বিদেশি সায়েবের দেশি নমুনায় বশীভূত হয় কি না কে জানে!
আলিপুর কোর্ট চত্বরে নেমে কর্নেল পকেট থেকে হরিবাবুর সেই কার্ডটা বের করে দেখে নিলেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন। ভিড়ে ভরা সংকীর্ণ রাস্তা, পাশে একটা ড্রেন। একটা ঝাকড়া গাছের তলায় তেরপল টাঙানো ছিল। সেখানে একটা টেবিল-চেয়ার এবং টেবিলে একটা ছোট্ট টাইপ রাইটার। কর্নেল সেখানে দাঁড়ালে এক তরুণ ছুটে এল। হরিকাকুকে খুঁজছেন স্যার? হোটেলে এক্ষুনি খেতে গেলেন। এসে পড়বেন শিগগির। একটু ওয়েট করুন।
কর্নেল বললেন, তুমি কি হরিবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট নাকি?
আমি স্যার এখানে সবাইকে হেলপ করি।
কী হেল্প করো?
হেলপ্ বোঝেন না স্যার?
কর্নেল হাসলেন। বুঝলাম। কিন্তু ধরো, আমার হঠাৎ এখনই একটা চিঠি লেখানোর দরকার। তুমি কি হেল্প করতে পারবে?
ওই তো মাখনদা টাইপ করছে। চলুন ওখানে।
নাহ্। আমার বাংলায় একটা চিঠি লেখাতে হবে।
এখানে তো বাংলায় টাইপ হয় না স্যার! নাকি হয়–দাঁড়ান, জিজ্ঞেস করে আসি।
হাতের লেখাই চলবে। খুলে বলি। তা হলেই বুঝবে। কর্নেল আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই ভদ্রলোক অবাঙালি ব্যবসায়ী। ইংরেজিও ভাল জানেন না। তা না হলে এঁকে দিয়েই লেখাতাম। একটু বুঝিয়ে লিখতে হবে। আর এই দেখ, আমার হাতের অসুখ। সব সময় খালি কঁপে।
কর্নেলের হাতের কাঁপুনি দেখে আমি হতবাক।
স্মার্ট তরুণটি বলল, খামে না পোস্টকার্ডে না ইনল্যান্ডে?
কর্নেল কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে একটা পোস্টকার্ড বের করে দিলেন। বললেন, আমার কাজের লোক বিষ্ণু দেশে গেছে। খুব অসুবিধে হচ্ছে। শিগগির আসতে লেখ। এমন করে লিখতে হবে যেন চিঠি পেয়েই চলে আসে। একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে ভাই। ওই পোস্ট অফিসে পোস্ট করে চলে যাব। ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি।
তরুণটি তক্ষুনি পোস্টকার্ডে দ্রুত কলম চালাল। এক মিনিটেই এক পৃষ্ঠা ভরিয়ে ফেলল। পরে পৃষ্ঠায় আধমিনিট। তারপর চোখ নাচিয়ে বলল, এমন লিখলাম স্যার, চিঠি পেয়েই–হুঁ। ইতি–আপনার নাম বলুন।
শিবপদ মজুমদার, ব্যস! আর কিছু না। ঠিকানা লেখো : বিষ্টুচরণ ধাড়া। গ্রাম আর পোস্ট অফিস গোবিন্দপুর। জেলা বর্ধমান। পিনকোড জানি না।
পোস্টকার্ড নিয়ে কর্নেল তাকে একটা পাঁচটাকার নোট দিলেন। সে টাকা পকেটস্থ করে বলল, হরিকাকু জানতে পারলে রাগ করবে। আপনারা কেটে পড়ুন স্যার। ওর আসার সময় হয়ে গেল।
তুমি হরিবাবুকে কিছু বলবে না। তা হলেই হল।
আমার মাথা খারাপ?
কর্নেল হন্তদন্ত ড্রেন ডিঙিয়ে চলতে থাকলেন। তারপর একটা ট্যাক্সিও ৪ গেল। ট্যাক্সিতে চেপে বললাম, ব্যাপারটা কী?
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, দৈবাৎ একটা চান্স পেয়ে গেলে ছাড়ি না। তবে আমি ঠিক এটাই ভেবে রেখেছিলাম। কোর্ট এলাকা বড় বিচিত্র, জয়ত। কত রকমের পেশার লোক ঘুরে বেড়ায়।
হেঁয়ালি শুনে চুপ করে গেলাম। কর্নেল পোস্টকার্ডে মন দিয়েছেন।
ইলিয়ট রোডের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল বললেন, এ বেলা আমার এখানে তোমার লাঞ্চের নেমন্তন্ন। বিকেলে দুজনে একসঙ্গে একবার বেরুব। কিন্তু না, কোনও প্রশ্ন কোরো না। শুধু চুপচাপ দেখে যাও। কেমন?
কর্নেল আমার কাধ চাপড়ে দিলেন। তারপর টেবিলের ড্রয়ার খুলে হরিবাবুকে লেখা লালকালির সেই চিঠিটা বের করে পোস্টকার্ডের লেখার পাশে রাখলেন। হাতে আতসকাঁচ। একটু পরে বললেন, ওই ছোকরা দারুণ চৌকস। হুমকি দেওয়া চিঠিটা ওর হাতেরই লেখা। খামের ঠিকানা অন্য কারও হাতের লেখা। যে হরিবাবুকে হুমকি দেওয়া চিঠিটা ওই ছোকরাকে দিয়ে লিখিয়েছে, সে খুব। সতর্ক। তাই হরিবাবুর ঠিকানাটা নিজের হাতে লিখেছে। পুলিশ যদি হাতের লেখা সনাক্ত করে শেষ পর্যন্ত ছোকরাটিকে পাকড়াও করে, বিপদটা ওর ঘাড় দিয়েই যাওয়ার চান্স ছিল। কিন্তু শেষমেশ হতটা কী? ছোকরাটির তো ওই ধরনেরই পেশা। তবে দেখ জয়ন্ত, ছোকরা বলা মানে গাল দেওয়া। ছেলেটি ভাল বাংলা লেখে। হয়তো খুব গরিব বলে বেশি লেখাপড়ার চান্স পায়নি। কিন্তু চলতি বাংলা চমৎকার আসে ওর হাত দিয়ে। ইচ্ছে করলে ছেলেটি লেখক হতে পারত এবং তোমার চেয়ে অনেক ভাল গদ্য লিখত, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।