বাড়ির সামনে একটুখানি লন মতো। সেখানে যথেচ্ছ দিশি-বিদেশি ফুলের গাছ এবং পাতাবাহার জঙ্গল করে ফেলেছে। বাঁদিকে নিচের তলার ঘরের জানালা থেকে একজন বুড়োসায়েব ফিসফিসিয়ে ডাকলেন, কর্নেল সরকার।
কর্নেল তাকে বললেন, প্লিজ ওয়েট আ বিট মিঃ ওলসন।
বাট দিস ইজ আর্জেন্ট, য়ু নো?
ওক্যে! ওকে! জাস্ট ওয়েট আ বিট।
বাড়ির বাইরের চেহারা জীর্ণ। কিন্তু সিঁড়িতে উঠতে উঠতে টের পাচ্ছিলাম ভেতরটা সুন্দর সাজানো-গোছানো। নেহাত কলগার্লদের ডেরা বলা হলেও এটা যে আসলে অভিজাত পতিতালয় তাতে কোনও ভুল নেই। তবে এ-ও ঠিক, সব ফ্লোরের ফ্ল্যাটগুলোর দরজা বন্ধ। সুনসান স্তব্ধতা ঘিরে আছে। চারতলায় দুটো ফ্ল্যাট এবং একপাশে ফাঁকা ছাদ অজস্র ফুলের টবে সাজানো।
দুজন কনস্টেবল বেতের চেয়ারে বসেছিল। উঠে দাঁড়াল আমাদের দেখে। পুলিশ অফিসার পকেট থেকে চাবি বের করে একটা ফ্ল্যাটের তালা খুলে দিলেন। লক্ষ্য করলাম, হাঁসকলে আরেকটা তালা ঝুলছে। ওটাই তাহলে ফ্ল্যাটের নিজস্ব তালা। এই বাড়তি তালাটা নিশ্চয় পুলিশের।
পুলিশ অফিসার বললেন, আপনি আবার আসবেন বলে ফ্ল্যাটের সবকিছু অ্যাজ ইট ইজ রাখা হয়েছে।
থ্যাংস্। বলে কর্নেল ঢুকলেন।
এটা ড্রয়িং রুম বলা চলে। কিন্তু আসবাবপত্র ওলটপালট ছত্রখান। কারা যেন প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি মারামারি করেছে এ ঘরে। ওল্টানো সেন্টার টেবিলের পাশে কাচের গ্লাস ভেঙে পড়ে আছে। একটা মদের বোতল কার্পেটের ওপর গড়াগড়ি খেতে খেতে দেয়ালের কোণায় আটকে গেছে।
বেডরুমের পর্দা ফর্দাফাই। কর্নেলের সঙ্গে ঢুকে শিউরে উঠলাম। মেঝের কাপের্ট এবং বিছানা রক্তে মাখামাখি। তবে এ ঘরেও একই ধস্তাধস্তি ওলটপালট হয়েছে।
কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন, কী বুঝছ বলো?
ধস্তাধস্তি মারামারির পর খুনটা হয়েছে?
হা চন্দ্রিকা যথাসাধ্য লড়েছিল এটুকু বলা চলে। বসার ঘরের কার্পেটে রক্তের ছিটে আছে। সেটা সম্ভবত খুনীর হাতের রক্ত। সে কিছু তন্নতন্ন খুঁজেছে খুন করার পরে।
পার্সের—
কর্নেল দ্রুত বললেন, এ ঘরে কোনও পার্স পাওয়া যায়নি জয়ন্ত।
ওঁর চোখের ভঙ্গিতে বুঝলাম, পার্স সম্পর্কে আমাকে চুপচাপ থাকতেই হবে। বললাম, পাশের ফ্ল্যাটে কেউ থাকে না? তার তো টের পাওয়া উচিত।
পুলিশ অফিসার বললেন, কেটি বলে একজন অ্যাংলো মেয়ে থাকত। সে কদিন আগে বোম্বেতে তার মায়ের কাছে চলে গেছে। আমরা চেক করেছি। একটা টেলিগ্রাম পাওয়া গেছে, মায়ের অসুখ। চাবি দিয়ে গেছে ওঁর কাছে।
কর্নেল ঘরের ভেতর এখানে ওখানে হুমড়ি খেয়ে বসে, কখনও দাঁড়িয়ে কী সব পরীক্ষা করছিলেন, তা উনিই জানেম। বললাম, কিন্তু ধস্তাধস্তির শব্দ নিচের ফ্ল্যাটের লোকেদের টের পাওয়া উচিত।
পুলিশ অফিসার মুচকি হেসে বললেন, এ বাড়িতে কোন ঘরে কী হচ্ছে, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। বুঝতেই পারছেন, বাড়িতে কারা থাকে। সারাদিন মদের ফোয়ারা ছোটে। আর হুল্লোড়।
কর্নেল বললেন, বেরুনো যাক এবার। নতুন কিছু দেখার মতো নেই মিঃ দাশ। আপনি দরজায় তালা এঁটে দিন। আমরা মিঃ ওলসনের ঘরে একটু আড্ডা দিয়ে চলে যাব। আপনি আপনার ডিউটি করুন।
নীচে ওলসন কর্নেলের অপেক্ষা করছিলেন। কর্নেল আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওলসন আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর জানালায় উঁকি মেরে বাইরেটা দেখে গদিআঁটা পুরনো একটা চেয়ারে ধপাস করে বসলেন। ওঁর চোখে উত্তেজনা জ্বলজ্বল করছিল। ফিসফিসিয়ে ইংরেজিতে বললেন, কর্নেল সরকার! আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ আগে মনে পড়ল কথাটা। তবে ফোনে বলতেও ভরসা পাইনি। বলা যায় না, আমার ফোন ট্যাপ করা আছে কি না।
এবার স্বচ্ছন্দে বলুন মিঃ ওলসন।
আপনাকে বলেছি, চন্দ্রিকা ওর পার্স কোথায় হারিয়ে আমার কাছে ওর ফ্ল্যাটের তালা খোলার জন্য সাহায্য চাইতে এসেছিল। আমি ওকে বললাম, তুমি ডিস্কোসায়েবকে ফোন করো। তার কাছে সব ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি থাকে। বলেছিলাম তো?
বলেছিলেন।
তখন আমার এখান থেকে চন্দ্রিকা ডিস্কো শয়তানটাকে ফোন করেছিল।
এ-ও বলেছে আমাকে।
ওলসন ঝুঁকে এলেন কর্নেলের দিকে। যেটা বলতে ভুলেছি, বলছি। ডিস্কোর ফোন নাম্বার আমি এতকাল জানতাম না। আমার বাড়ির কোনও খানকিই আমাকে সেটা জানাতে চায় না। চন্দ্রিকাও না। কিন্তু চন্দ্রিকা যখন ফোনে ডায়াল করছিল, নাম্বারগুলো– আমি দেখে নিয়েছিলাম। ভুলে যাব বলে একটু পরেই তা লিখে রেখেছিলাম। এখন নাম্বারটা আপনাকে দিতে পারি।
বলে হ্যারি ওলসন পকেট থেকে একটা চিরকুট দিলেন কর্নেলকে। কর্নেল সেটা দেখে পকেটে ভরলেন। তারপর বললেন, ডিস্কোকে আপনি কখনও দেখেননি বলছিলেন। তো–
হ্যাঁ। ওর লোকেদের দেখেছি। নচ্ছার গুণ্ডা তারা।
তো তারপর চন্দ্রিকা ওপরে চলে যায়, বলেছিলেন।
ঠিক। তারপর আর কিছু জানি না। ওলসন বিমর্ষ মুখে বললেন। কিন্তু ডিস্কো হারামজাদা চন্দ্রিকাকে যার হাত দিয়ে চাবি পাঠিয়েছিল, সেই খুন করেনি তো?
খুনের কী মোটিভ থাকতে পারে তার?
ওলসন একটু ভেবে বললেন, এমনও হতে পারে ডিস্কোশয়তানটার হুকুমেই সে চন্দ্রিকাকে খুন করে গেছে। সম্ভবত চন্দ্রিকা ওকে ব্ল্যাকমেল শুরু করেছিল।
এ কথা কেন আপনার মনে হচ্ছে মিঃ ওলসন?