আপনি গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। আমার জানার ইচ্ছে ছিল গতরাতের সেই মেয়েটিই কিনা। যদি সে না হয়, তা হলে আমার কিছু করার নেই। তো গিয়ে দেখি, সে-ই। মুখটা মনে ছিল। তুমি তো জানো, মানুষের মুখ সম্পর্কে আমার নিজস্ব কিছু তত্ত্ব আছে। চন্দ্রিকা রায়ের মুখে বিপন্নতা লেখা ছিল। কিন্তু সেটা এতদুর গড়াবে ভাবতে পারিনি।
ওর ফ্ল্যাটের চাবি তো পার্সে।
নো পার্স। চেপে যাও।
ফ্ল্যাটে ঢুকল কী করে চন্দ্রিকা?
যে ভাবেই হোক, ঢুকেছিল। তারপর খুনী ওকে জবাই করেছে। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই জবাই। কর্নেল তেমনই নির্বিকার মুখে বললেন। তোমাকে বলেছিলাম, কলগার্লদের জীবন সবসময়ই বিপন্ন। কেন বিপন্ন সেটা একটু চেষ্টা করলেই বুঝতে পারবে। এক্ষেত্রে পুলিশের বক্তব্য অবশ্য একটু অন্যরকম। চন্দ্রিকাকে খুন করা হয়েছে ডাকাতির উদ্দেশ্যে। আজকাল নাকি ফ্ল্যাটে ডাকাতি এবং খুন যে ভাবে হচ্ছে, সেভাবেই। কারণ ওলসনের বাড়ির কলগার্লদের গার্জেন ডিস্কোর কাছে চন্দ্রিকা ছিল এক দুর্মূল্য সম্পদ।
ডিস্কো কে?
এখনও তাকে দেখিনি। জানি না কে সে। জানতেও চাই না। ডিস্কো ইজ ডিস্কো। দ্যাটস অল।
চন্দ্রিকার পার্সের ভেতর শেই কাগজটা—
নো পার্স! কর্নেলের চোখে ভর্ৎসনা ফুটে উঠল। কথাটা বলে উঠে গেলেন জানালার কাছে। পর্দা তুলে উঁকি দিয়ে নিচের রাস্তা দেখতে থাকলেন।
কিছুক্ষণ পরে সরে এসে ইজিচেয়ারে বসলেন কর্নেল। সহাস্যে বললেন, পুলিশের জিপে হালদারমশাই আসছেন। ভাবা যায়? চিন্তা করো ডার্লিং! ভদ্রলোক নিজেই চৌত্রিশ বছর পুলিশে চাকরি করেছেন। রিটায়ার করে ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন। অথচ পুলিশ ওঁকে সহ্য করতে পারে না এবং উনিও পুলিশকে সহ্য করতে পারেন না। সম্পর্কটা প্রায় সাপে-নেউলে বলা চলে। অথচ এতদিন পরে এই একটা ঘটনায় সাপ-নেউলের চমৎকার গলাগলি। দেখা যাক, এই গলাগালি থেকে চন্দ্রিকা হত্যার কোনও সূত্র বেরিয়ে আসে নাকি!
ঘণ্টা বাজলে ষষ্ঠীচরণ গিয়ে দরজা খুলে দিল। তারপর প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার নস্যির কৌটো হাতে হাসিমুখে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর পিছনে এক পুলিশ অফিসার। হালদারমশাই ধপাস করে বসে এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, গুপ্তসায়েবরে জিগান, কী কইছিলাম?
পুলিশ অফিসার গম্ভীরমুখে বললেন, কর্নেলসায়েব কি ডি সি ডি ডি লাহিড়িসায়েবের ফোন পেয়েছেন?
কর্নেল বললেন, অরিজিৎ বলছিল, আপনি যোগাযোগ করবেন। জয়ন্ত, আলাপ করিয়ে দিই। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ অশোক গুপ্ত। আমার স্নেহভাজন বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসবেক পত্রিকার সাংবাদিক।
অশোক গুপ্ত নমস্কার করে বললেন, কাগজে নামটা দেখেছি। একটা অনুরোধ জয়ন্তবাবু। যদি কাগজে কিছু লেখেন, এমন কিছু লিখবেন না যাতে আমাদের তদন্তে ব্যাঘাত ঘটে।
বললাম, কিছুই লিখব না। আমাদের কাগজের ক্রাইম-রিপোর্টার আছে। সে আপনাদের ভার্সানই লেখে। কাজেই যা লেখার সে-ই লিখবে। …
আবার একদফা কফি এল। হালদারমশাইয়ের জন্য তিন ভাগ দুধ মেশানো কফি আনতে ষষ্ঠী ভোলেনি। চুমুক দিয়ে হালদারমশাই সন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, ফার্স্ট ক্লাস! এবার অশোকবাবু কইবেন, নাকি আমি স্টার্ট করব? কর্নেলস্যার কী কন?
কর্নেল বললেন, আপনারটা আগে শুনে নিই।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মিশ্র ভাষায় যা শুরু করলেন, তার সারমর্ম এই :
হালদারমশাই মাঝে মাঝে কাগজে তাঁর এজেন্সির বিজ্ঞাপন দেন। গত সপ্তাহে দিয়েছিলেন। কদিন আগে চন্দ্রিকা রায় তাঁর অফিসে গিয়েছিল। তাকে নাকি প্রায়ই একটা অচেনা লোক টেলিফোন করে জ্বালাতন করছে। কী একটা অদ্ভুত কথা বলছে, যার মাথামুণ্ডু বোঝা যায় না। আগের দিন চন্দ্রিকা নিউ মার্কেটে গিয়েছিল। ভিড়ের ভেতরে কেউ তাকে ফিসফিস করে একই কথা বলে ওঠে। কে বলল, চন্দ্রিকা খুঁজে পায়নি। কিন্তু ভীষণ ভয় পেয়ে চলে আসে। হালদারমশাই চন্দ্রিকার কেসটি যথারীতি গুরুত্বসহকারে হাতে নেন। চন্দ্রিকার বাসস্থানের কাছে অর্থাৎ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ওই বাড়ির সামনে ফুটপাতে পুরো একটা দিন ওত পেতে থাকেন এবং নিজস্ব গোয়েন্দা-পদ্ধতিতে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, বাড়িটা কলগার্লদের খাঁটি। চন্দ্রিকাও একজন কলগার্ল। তবে সেটা কোনও ব্যাপার নয়। চন্দ্রিকা তাঁর ক্লায়েন্ট।
উল্লেখ করা দরকার, হালদারমশাই কেস পেলে যা করেন, অর্থাৎ ছদ্মবেশ ধরেই ওত পাততে গিয়েছিলেন। ভবঘুরে ফুটপাতবাসীর ছদ্মবেশ। গত পরশু শুক্রবার বিকেলে ফের যান উনি। সেই সময় সেজেগুঁজে চন্দ্রিকা বেরুচ্ছিল। তার পিছু নেন। চন্দ্রিকা পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। হালদারমশাই ভেবেছিলেন, সে খদ্দের ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে একটা সাদা গাড়ি এসে থামে এবং চন্দ্রিকা তাতে চাপে। ভবঘুরে টাইপ নোংরা পোশাকপরা লোককে কোনও ট্যাক্সি ড্রাইভারই নেবে না। কাজেই গাড়ির নাম্বার টুকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় গোয়েন্দাকে। পরদিন শনিবার মোটর ভেহিকলস ডিপার্টমেন্টে চেনা লোকের সাহায্যে গাড়ির মালিকের নাম-ঠিকানা যোগাড় করেন। তারপর সেই ঠিকানায় চলে যান। গিয়েই একটু অবাক হন।
এ পর্যন্ত শুনেই কর্নেল হঠাৎ বলে উঠলেন, ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির বাড়ি?