কয়েকটা উজ্জ্বল সার্চলাইট জ্বলে উঠল। চত্বরের ধাপ বেয়ে উঠে কর্নেলকে অনুসরণ করলাম। বিধ্বস্ত বিশাল মন্দিরের গা ঘেঁষে একটা বটগাছ ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার তলায় হালদারমশাই ডিস্কো-কে মাটিতে পেড়ে ফেলে বুকের ওপর বসে আছেন। তাঁর দুটো পা ধরাশায়ী ডিস্কোর দুই হাতের ওপর।
ডিস্কোরর মুখে মুখোশ আঁটা। কর্নেল কাছে গিয়ে বললেন, অশোকবাবু, রথীন চৌধুরী, স্বপন দাশ এবং চন্দ্রিকা রায়ের খুনী ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিকে গ্রেফতার করুন। সাবধান! আগে হ্যাণ্ডক্যাপ পরিয়ে দিন।
কলকাতা থেকে পুলিশের ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর অশোক গুপ্ত সদলবলে এসে পড়েছেন, এটা কর্নেলেরই পরিকল্পনা তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। সৌরভ-নাট্যগোষ্ঠীর নাট্যকার পরিচালক-অভিনেতা এবং প্রাক্তন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিই যে স্বয়ং ডিস্কো, এটা আমার কাছে একেবারে অবিশ্বাস্য। একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি না তো? মুখোশের আড়ালে নিশ্চয় অন্য কোনও মুখ আছে।
হালদারমশাই উঠে দাঁড়ালেন। তাগড়াই পুলিশেরা হাতকড়া পরিয়ে ডিস্কোকে টেনে ওঠাল। তখন কর্নেল ডিস্কোর মুখোশটা এক টানে খুলে নিলেন। এবার স্পষ্ট ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিকেই দেখলাম। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। ইন্দ্রজিৎবাবুর চোখমুখ ফাঁদে পড়া শ্বাপদের মতো। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ছেন।
হালদারমশাই খি-খি করে হেসে বললনে, পরগাছা হেই চত্বরে রাইখ্যা চিন্তা করলাম, কোন হালা আইয়া পরগাছা লয় দেখা উচিত। টাইমবোমা ফাটব কইছিলেন। তাই ঘুর পথে বনবাদাড় দিয়া ফিরিয়া আইলাম। হেই গাছে চড়লাম, কিছুক্ষণ পরে চত্বরে আলো পড়ল। দুইজন আইছিল। প্রাইভেট ডিটেকটিভ তার দুটো লম্বা আঙুল দেখালেন। একজন কইল, তুমি গাড়ির কাছে যাও। বুড়া রাত্র দশটায় আইব। আমি ওয়েট করি। হঃ। এই হালা! বলে প্যান্টের পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করে নস্যি নিলেন হালদারমশাই। ফের চিন্তিতমুখে বললেন, টাইম যোমা ক্যান ফাটল না?
কর্নেল বললেন, বিগড়ে গেছে হালদারমশাই।
অশোকবাবু বললেন, ইন্দ্রজিৎবাবু! হাইওয়েতে আপনার গাড়িটা আমরা অলরেডি সিজ করেছি। আপনার দুই চেলা ছিল। তারা এতক্ষণ থানার হাজতে। আপনার আরও তিনজন লোককে রাত আটটায় নদীর ব্রিজেই পাকড়াও করেছি। আপনাকে ডি সি ডি. ডি লাহিড়িসায়েব জানাতে বলেছেন, তিনি আর আপনার বন্ধু নন।
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির পোশাক হাতড়ে কর্নেল কালো কৌটোটা খুঁজে বের করে ঝটপট তালা খুলে ভেতরটা দেখালেন। বললেন, দেখছেন তো ইন্দ্রজিত্বাবু! এতে কোনও নকশা নেই! কাজেই অযথা হরনাথবাবুকে আটকে রেখে লাভ নেই। বলুন, তাঁকে কোথায় রেখেছেন?
অশোকবাবু একটু হেসে বললেন, ইন্দ্রজিৎবাবুর গাড়িতেই হরনাথবাবুকে আমরা উদ্ধার করেছি। হাত-পা বাঁধা এবং মুখে টেপসাঁটা অবস্থায় গাড়ির ভেতরে ওঁকে ফেলে রেখে পাহারা দিচ্ছিল দুই চেলা। ডিস্কোসায়েব গিয়ে এবার নিশ্চয় হরনাথবাবুকে মুক্তি দিতেন। চলুন, থানায় ফেরা যাক।
কর্নেল বললেন, আপনারা তো হাইওয়ের দিকে যাবেন। আমি আর ওদিকে যাচ্ছি না। ফরেস্ট বাংলো বুক করা আছে। সেখানেই উঠব। কলকাতা ফিরে দেখা হবে।
অশোকবাবু সদলবলে আসামীকে নিয়ে সার্চ লাইটের আলোয় জঙ্গল প্রায় জ্বালিয়ে দিতে দিতে চলে গেলেন।
.
ব্রিজের কাছে এসে হালদারমশাই বললেন, আমি আমার ক্লায়েন্টের ফার্মে যাই গিয়া। ওনার ওয়াইফেরে দিদি কইছি। বোঝলেন না? নিজের হাতে রান্না কইরা খাওয়াইবেন কইছেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভ তার অনবদ্য খি-খি খুশির হাসি হেসে লম্বা পায়ে এগিয়ে গেলেন। দেখতে দেখতে টর্চের আলো মিলিয়ে গেল।
কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলাম, ফরেস্ট বাংলো কত দূর? আমার ঠ্যাং দুটোয় জ্যাম ধরে গেছে।
কর্নেল বললেন, কাছেই। ওই দেখ, আলো জ্বলছে। নদীর ধারে টিলার ওপর অসাধারণ একটা রিসর্ট।
চড়াই ভেঙে বাংলোয় পৌঁছুতে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। চৌকিদার প্রতীক্ষা করছিল কর্নেলের। আমরা বারান্দায় বসার পর সে শীগগির কফি করে আনল। কর্নেলের সঙ্গে তার কতাবার্তা শুনে বুঝলাম আজ রাত্রে যে কোনও সময়ে কর্নেল পৌঁছুবেন বলে খবর পেয়েছিল সে। তাই বাড়ি চলে যায়নি। এ-ও বুঝলাম, কর্নেল তার সুপরিচিত।
কফি খাওয়ার পর চাঙ্গা হয়ে বললাম, ডিস্কো নামের আড়ালে যে ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিই আছেন, কী করে বুঝলেন?
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, প্রথম খটকা বাধে, চন্দ্রিকা খুন হওয়ার পর তার পার্স সম্পর্কে ইন্দ্রজিতের আগ্রহ দেখে। কিন্তু কী অসাধারণ ধূর্ত আর নিষ্ঠুর লোক এই ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি। চিন্তা করে দেখ। ডিস্কোর অস্তিত্ব আমার কাছে সত্য বলে প্রমাণের জন্য সে কত কাণ্ড করে বসল। চন্দ্রিকাকে খুনের অস্ত্র উদ্ধার করে দিল। নিজের এক চেলা স্বপনকেও খুন করল। শেষে নিজেকে নিজেই কিডন্যাপ করল। এক লক্ষ টাকা নিজের স্ত্রীর হাত দিয়ে নিজেই নিল। মৃদুলার অবশ্য এটা জানার কথা নয়। তবে মৃদুলার কথায় আভাস পেয়েছিলাম, অত নগদ টাকা নিশ্চয়ই ঘরে আছে। আসলে ইন্দ্রজিৎ ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে রেখেছিল। ওর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট থেকে চেক করে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। আসলে ইন্দ্রজিৎ চন্দ্রিকার কাছে কোড নাম্বারটা হাতাতে না পেরে একটা বড় রকমের প্ল্যান ফেঁদেছিল। আমার হাত দিয়ে সে ওটা হাতানোর উদ্দেশ্যেই ডিস্কোর হুমকির কাল্পনিক ধুয়ো তুলে অরিজিতের মাধ্যমে আমার দ্বারস্থ হয়। সত্যকামই তাকে আমার পরিচয় দিয়ে থাকবে। এবার পয়েন্ট বাই পয়েন্ট ওর প্ল্যানটা লক্ষ্য করো। পরগাছা নাটক মঞ্চস্থ করার রাত থেকে ইন্দ্রজিতের অভিযান শুরু। দিন ধরে ডিস্কোর ব্যাকগ্রাউণ্ড তৈরি করার পর সে গত রবিবার অ্যাকশনে নেমেছিল।