কতক্ষণ পরে হলঘরের দেয়ালঘড়িতে ঢং ঢং করে নটা বাজল। বেচু দরজার কড়া নেড়ে ডাকল, খাবার রেডি স্যার!
কর্নেল কিটব্যাগ হাতে নিয়ে দরজা খুললেন। ইশারায় আমাকেও আমার কিটব্যাগটা নিতে বললেন। আমরা ডাইনিং রুমে ঢুকলে বেচু বললু, দিদিমণির হঠাৎ শরীর খারাপ। কর্তামশাই ওনার ঘরে বসে আছেন। বললেন, একটু পরে আসবেন। আপনারা খেয়ে নিন।
কর্নেল বললেন, বেচু! এই প্যাকেটটা তুমি সত্যকামকে, দেবে। খুলো না যেন। মন্ত্র ভরা আছে। বিগড়ে যাবে। অনেক দাম।
বেচু সেই প্যাকেটটা ফ্রিজের মাথায় যত্ন করে রেখে দিল।
খাওয়া সেরে কর্নেল বললেন, কর্তামশাইকে বোলো, বেরুচ্ছি। যদি রাত্রে আর না ফিরি, যেন চিন্তা না করেন।
বেচু গম্ভীর মুখে বলল, এত রাত্তিরে কোথায় যাবেন স্যার?
কলকাতায় যাত্রা শুনতে।
বেচু হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দরজার পাশ থেকে একটা লাঠি নিয়ে হাঁক ছাড়ল, তবে রে! ভারি মজা পেয়ে গেছ। তাই না? সে তাড়া করে গেল।
সেই কালো বেড়ালটাকে জানালা গলিয়ে পালাতে দেখলাম। …
.
জানতাম, কর্নেলের গন্তব্য ভবানীমন্দির। তাই কোনও প্রশ্ন করিনি। নদীর ব্রিজ পৈরিয়ে রাস্তা ডানদিকে মোড় নিয়েছে। কর্নেল বাঁদিকে খোলামেলা মাঠে হাঁটতে থাকলেন। অন্ধকারে উনি নাকি দিব্যি দেখতে পান। আমি পাই না। সাবধানে পা ফেলে ওঁকে অন্ধের মতো অনুসরণ করছিলাম।
মাঠটা ঢালু হয়ে নেমেছে। বারকয়েক হোঁচট খেলাম। তারপর অন্ধকারে জমাট কালো একটা জঙ্গলে ঢুকলাম। কর্নেল আস্তে বললেন, আমাকে ছুঁয়ে এস। নইলে হারিয়ে ফেলবে।
বললাম, আর কতদূর?
কাছেই।
জঙ্গল শেষ হলো। একটা খোলামেলা জায়গায় পৌঁছে কর্নেল আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, সামনে উঁচু চত্বর আছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকব চত্বরের নিচে। তুমি চত্বরের তলায় গুঁড়ি মেরে বসবে। টর্চ রিভলভার তৈরি রেখো।
চত্বরটা নক্ষত্রের আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছিল। কর্নেল গিয়ে ধাপের কাছে পড়ালেন। পাশে আমি গুঁড়ি মেরে বসলাম। চারপাশে পোকামাকড়ের ডাক। একটা প্যাঁচা কর্কশ শব্দে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। তারপর দূরে শেয়ালের ডাক শোনা গেল।
কর্নেল লাইটার জ্বেলে চুরুট ধরালেন। তারপর আস্তে ডাকলেন, মিঃ ডিস্কো!
কোনও সাড়া এল না।
আবার কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ডাকলেন, মিঃ ডিস্কো! আর য়ু দেয়ার?
এবার চাপা গলায় সাড়া এল, কর্নেল সরকার!
আসুন। ভদ্রলোকের চুক্তি মিঃ ডিস্কো।
আপনি ওটা ওখানেই এক টুকরো পাথরে চাপা দিয়ে রেখে যান।
কিন্তু হরনাথবাবুকে যে ফেরত চাই।
ফার্ম হাউসে গিয়ে অপেক্ষা করুন। পেয়ে যাবেন।
দুঃখিত মিঃ ডিস্কো! ভদ্রলোকের চুক্তি। এমন তো কথা ছিল না।
কী কথা ছিল?
আপনি যা লিখেছিলেন পড়ে শোনাব?
অত সময় নেই। তাড়াতাড়ি করুন।
আপনি লিখেছিলেন, জিনিসটা আপনার হাতে পৌঁছে দিতে। আপনার হাতেই তা তুলে দিতে চাই।
চালাকি ছাড়ুন। আমাকে ফাঁদে ফেলতে পারবেন না। চারদিকে আমার লোক তৈরি আছে।
আমি চালাকি করছি না। আমি আপনার বুদ্ধির চাতুর্যে মুগ্ধ। তাই আপনার হাতের স্পর্শ পেতে চাই মিঃ ডিস্কো!
দেরি করবেন না। বিপদে পড়বেন তা হলে।
আপনি টর্চের আলোয় দেখুন, আমি নিরস্ত্র। আমার হাতে সেই কোড নাম্বার লেখা কাগজ। আপনার দেখা উচিত, কাগজটা জাল, কি না। আপনি ওটা দেখলেই চিনতে পারবেন। কারণ চন্দ্রিকা আপনাকে নিশ্চয়ই ওটা দেখিয়াছিল!
দেখায়নি।
আই রিপিট মিঃ ডিস্কো, দেখিয়েছিল। কিন্তু তখন আপনি বুঝতে পারেননি ওটা কী।
একটু পরে ডিস্কোর কথা শোনা গেল, কে বলল আপনাকে?
আপনিই বলেছিলেন আমাকে। তবে পরোক্ষ।
ননসেন্স! দেরি করবেন না।
মিঃ ডিস্কো! আপনি কি জিজ্ঞেস করেননি আমাকে চন্দ্রিকার পার্সের কথা?
ড্যাম ইট! এক মিনিট সময় দিচ্ছি।
ঠিক আছে। আপনার কথামতো পাথর চাপা দিয়ে রেখে যাচ্ছি। কর্নেল টর্চের আলো পায়ের কাছে ফেলে এক টুকরো পাথর কুড়িয়ে নিলেন। তারপর উঁচু চত্বরের ওপর হতে বাড়িয়ে সেই চিরকুটটা রেখে পাথর চাপা দিলেন। উত্তেজনায় আমি ততক্ষণে একটু উঠে দাঁড়িয়ে চত্বরের কিনারায় উঁকি দিয়েছিলাম। দেখে নিয়েই বসে পড়লাম।
আলো নিভিয়ে কর্নেল কয়েক পা এগিয়ে চত্বর থেকে দূরে গেলেন, যেন ফিরে চলেছেন। চত্বরের পিছন থেকে একঝলক টর্চের আলো এসে পড়ল। তারপরই আলোটা নিভে গেল। চাপা শব্দ শুনতে পেলাম চত্বরের ওপর। পাথরটা গড়িয়ে ফেলে দিয়ে কেউ কাগজটা তুলে নিল।
সেই সময় কর্নেলের চাপা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ঠিক সেই কাগজটা তো মিঃ ডিস্কো?
ইউ ব্লাডি ওল্ড হ্যাগার্ড! এখনও চলে যাওনি তুমি?
টর্চের আলো পড়তে থাকল চারদিকে। কিন্তু কোথাও কর্নেলকে দেখতে পেলাম না। বুঝলাম পাথরের আড়ালে বা ধ্বংসস্তূপের পিছনে কোথাও আছেন। আমি চত্বরের নিচে গুটিসুটি বসে আছি। কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছি না।
হঠাৎ আমাকে স্তম্ভিত করে কর্নেল বলে উঠলেন, ইন্দ্রজিৎবাবু! দা গেম ইজ ওভার। ফায়ার আর্মস্ ফেলে দিন। পুলিশ আপনাকে ঘিরে ফেলেছে।
চারদিক থেকে ঝলকে ঝলকে টর্চের আলো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। চত্বরে কেউ নেই। কর্নেলকে ছুটে আসতে দেখলাম। এদিক ওদিক থেকে পুলিশও এগিয়ে আসছিল বন্দুক তাক করে। তারপরই মন্দিরের পেছনদিকে হালদারমশাইয়ের চিৎকার শুনতে পেলাম। কর্নেলস্যার! কর্নেলস্যার! হালারে ধরছি।