কতদূর ঘুরলেন?
চেয়ারে বসে বললাম, নদীর ব্রিজ অব্দি। কর্নেলের বাতিক তো জানেন। পাখি প্রজাপতির পেছনে ছুটোছুটি করে বেড়ালেন। তারপর হঠাৎ খেয়াল হলল, চুরুট ফুরিয়ে গেছে।
বেচু দাঁড়িয়ে গাল চুলকোচ্ছিল। অমরেন্দ্র বললেন, কী রে? দাঁড়িয়ে থাকবি না এঁর জন্য চা-কফি কিছু আনবি?
বেচু বলল, চা খাবেন, না কফি খাবেন স্যার?
বললাম, বরং কড়া করে এক কাপ চা আনো।
বেচু চলে গেল। অমরেন্দ্র হাসলেন। হ্যাঁ। বাইরে বেড়িয়ে এসে কড়া চা আমারও খুব পছন্দ। কর্নেলসায়েব কেন যে শুধু কফি খেতে ভালবাসেন, বুঝি না।
ওঁর মতে, কফি নাকি নার্ভকে চাঙ্গা করে।
অমরেন্দ্র খুব হাসলেন। কে জানে। যার যাতে অভিরুচি। গম্ভীর মুখে চাপা স্বরে ফের বললনে, কর্নেলসায়েব হরনাথের ফার্মে যাননি।
না তো।
ভবানীমন্দিরে?
নাহ। উনি বলছিলেন, প্রাইভেট ডিটেকটিভ যখন এসে গেছে, তিনিই হরনাথবাবুকে উদ্ধার করে ফেলবেন।
অমরেন্দ্র একটু চুপ করে থেকে বললেন, হরনাথ সেদিন কলকাতার এক ভদ্রলোককে আমার বাড়িতে এনেছিল। লম্বা গড়ন। পেল্লার গোঁফ আছে। ইস্টবেঙ্গলের লোক। আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে, তিনিই কি ডিটেকটিভ? কিন্তু হরনাথ কেন ডিটেকটিভ ভাড়া করবে? কোনও বিপদ আঁচ করেছিল নাকি? অথচ আমাকে কিছু জানাল না, এটাই আশ্চর্য!
বেচু ঝটপট চা দিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, আপনার অ্যালসেসিয়ানটা মারা গেছে শুনলাম। বেচু বলছিল।
হ্যাঁ। বিমর্ষ মুখে অমরেন্দ্র বললেন, ভুলটা আমারই। কিছুদিন থেকে কেমন ঝিম ধরে বসে থাকত। রাত্রে অত অদ্ভুত কাণ্ড হতো। সাড়া দিত না। তখন বুঝিনি জনি অসুস্থ। আসলে ওর দিকে ইদানিং তত লক্ষ্য ছিল না। ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা নিয়েই মাথা ঘামাতাম।
অমরেন্দ্র এবার তার প্রিয় কুকুরের জীবনী এবং তার পরিবারের ইতিহাস শোনাতে শুরু করলেন। শেষে নিজের রাজনৈতিক কীর্তিকলাপের কাহিনীর পাতা খুললেন। বটুক চৌধুরী ছিলেন তার বন্ধু। হঠাৎ বটুকবাবু দল বদলে তার ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন। শালা-ভগ্নিপতির এই লড়াই নিয়ে লোকে ঠাট্টা তামাশা করত। তাই রাজনীতি ছেড়ে দেন অমরেন্দ্র।
বারবার ঘড়ি দেখছিলাম। কর্নেল ফিরলেন প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে। ফিরেই বললেন, রায়সায়েব, ডিনার খাব কিন্তু রাত নটায়। তারপর আবার বেরুতে হবে।
অমরেন্দ্র বেচুকে ডেকে তাড়া দিলেন। তারপর আমাদের সেই ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, সুনন্দার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। এদিকে সতুর মতিগতিও ভাল ঠেকছে না।
কর্নেল বললেন, কেন?
অমরেন্দ্র চাপা স্বরে বললেন, কোনওদিন বাড়ি ফেরে, কোনওদিন ধানবাদে থেকে যায়। আজ বলে গেছে বাড়ি ফিরবে না। চেহারা দেখে মনে হয়, নেশা-ভাং ধরেছে। কোনদিক সামলাব ভেবে পাচ্ছি না। আপনারা বিশ্রাম করুন। আমি আসছি। কফি বলব নাকি?
থাক। বাজারে একটা কাফে সেন্টার দেখলাম। সেখানেই কফি খেয়ে নিয়েছি।
অমরেন্দ্র হাসলেন। ভিডিও সেন্টার বলুন! আজকাল এই এরিয়ায় কাফে সেন্টার, কফি হাউস অনেক হয়েছে। সব কিন্তু বুঝলেন তো? ব্লু ফিল্মের বদমাইশি।
.
কর্নেল ঘরের দরজা বন্ধ করে চেয়ারে বসলেন। আমি বাথরুমে গিয়ে মুখহাত রগড়ে লাম। ক্লান্তি চলে গেল। একটু পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি, কর্নেল একটা খুদে ক্যাসেট এবং একটা গোল ছোট্ট কী যন্ত্র টেবিলে রেখে খুঁটিয়ে দেখছে। এলাম, কী ওগুলো?
কর্নেল হাসলেন। সেই ভূত দুটো।
ভূত দুটো তার মানে?
তুমি হলঘরে কালো ঘেঁড়া তারটা দেখেছিলে। বরগার খাঁজে গোল দাগটা লক্ষ্য রোনি। এটা একটা খুদে মাইক্রোফোন। আর এটা একটা টেপ। টেপরেকর্ডারে ঢুকিয়ে সুইচ অন করলে নানারকম ভৌতিক শব্দ শোনা যাবে। একটা বিদেশি সাউণ্ডরেকর্ড। আমেরিকায় দেখেছি, হ্যালোউইন পরবের রাত্রে ছোট ছেলেমেয়েরা এটা বাজিয়ে বড়দের ভয় দেখায়।
কোথায় পেলেন ও দুটো?
কালো তারটা সত্যকামের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে দেখে মাস্টার কী দিয়ে ওর ঘরের তালা খুলেছিলাম। বিছানার তলায় পেয়ে গেলাম। ব্যাপারটা বুঝতে পারছ? আমি আসব শুনেই সত্যকাম খুদে মাইক্রোফোনটা খুলে নিয়েছিল। তাই আর ভূতের উপদ্রব হচ্ছিল না।
শুনে চমকে উঠেছিলাম। বললাম, সত্যকাম ডিস্কোর চেলা হয়েছে?
টাকার লোভে হয়েছে। তাছাড়া ডিস্কো ওর চেনা লোক। একটা চিঠিও উদ্ধার করেছি বিছানার তলা থেকে। ডিস্কো খবর পেয়েছিল নক্সাটা হরনাথ রায়সায়েবের ঘরে লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু ডিস্কো একটা ভুল করেছিল। চিচিং ফাঁক কথাটা হরনাথ জানেন এবং তার বন্ধুকেও জানিয়েছেন ভেবেছিল ডিস্কো। আমার ধারণা, চন্দ্রিকা নকশাটা জ্যাঠার কাছে গোপনে রেখে গেলেও ওটার সাংকেতিক নাম যে চিচিং ফাঁক, তা বলেনি।
চিঠিটা দেখি।
কর্নেল বললেন, যথাসময়ে দেখাব। ব্যস্ত হয়ো না। বলে চুরুট ধরিয়ে কিটব্যাগ থেকে একটা খবরের কাগজ বের করলেন। সেই কাগজে খুদে টেপ এবং মাইক্রোফোনটা প্যাকেটবন্দি করে সুতো দিয়ে পরিপাটি করে বাঁধলেন। তারপর ডটপেনে বড় বড় হরফে প্যাকেটের ওপর লিখলেন, সত্যকামকে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের উপহার।
বললাম, এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে, কুকুরটাকে সত্যকামই বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে।
হ্যাঁ। সম্ভবত কালো বেড়ালটা এ বাড়িতে আনাগোনা যাতে নির্বিবাদে করতে পারে, সেজন্যই কুকুরটাকে মেরে ফেলার দরকার ছিল। কালো বেড়ালের রক্ত খাওয়া এবং যাতায়াত ভৌতিক রহস্যকে জমজমাট করে ফেলেছিল। অসহায় রোগা কুকুরটা চুপচাপ দেখত। দৃশ্যটা কল্পনা করা যায়! কর্নেল চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। থাক ও সব কথা। এবার শেষরক্ষা কীভাবে হয়, সেই চিন্তা। হালদারমশাই কোনও বিভ্রাট বাধালেই সমস্যায় পড়ব।