কর্নেল সাবধানে পায়ের কাছে টর্চ ফেলে এগিয়ে গেলেন সেই গাছটার দিকে। তারপর যেখানে অর্কিডটা পড়েছিল, সেখানে আলো ফেললেন। ভেঁড়াখোঁড়া ফুল আর কিছু পাতা পড়ে আছে। কর্নেল মাটির ওপর আলো ফেলে ডানদিকে এগিয়ে গেলেন। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। কর্নেল এদিকে-ওদিকে আলো ফেলতে ফেলতে একজায়গায় থমকে দাঁড়ালেন। ফিসফিস করে বললেন, কানের ভুল হতেও পারে। কী একটা শব্দ শুনেছিলাম-শব্দটা অন্যরকম।
বললাম, আমি শুধু অর্কিড পড়ার শব্দ শুনেছি।
নাহ্। আমি আরও একটা শব্দ শুনেছি। কর্নেল একটু এগিয়ে গেলেন। তারপর সামনে ঝুঁকে কী একটা কুড়িয়ে নিয়ে বললেন, পাওয়া গেল। কিন্তু এবার হালদারমশাই বিপদের মুখে পড়লেন। হরনাথবাবুর অবস্থাও অনিশ্চিত হয়ে উঠবে। জয়ন্ত! কুইক!…
.
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গিয়ে দেখলাম, দিনের আলো তখনও একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। তবে ফার্মের মাঠে আলো জুগজুগ করছে কাছে ও দূরে। যেখানে বড় বড় পাথর পড়ে থাকতে দেখেছিলাম, সেখানে পৌঁছে কর্নেল হাঁটু দুমড়ে বসলেন। আমিও বসে পড়লাম। কর্নেলের হাতে ফিকে হলুদ রঙের একটা মোড়ক। ভিডিও। ক্যাসেটের সাইজ মোড়কটার এক দিকে টেপ সাঁটা। কর্নেল টেপ ছিঁড়ে মোড়কটা খুললেন। কালো রঙের চৌকো একটা জিনিস বেরুল। ওটার একদিকে গোল চাকতি বসানো। কর্নেল প্যাকেটের ভেতরপকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করলেন। দেখামাত্র চিনতে পারলাম। এই চিরকুটটাই চন্দ্রিকার পার্সে লুকোনো ছিল।
কর্নেল চিরকুটটা দেখে নিয়ে গোল চাকতিটা ঘোরাতে থাকলেন। আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। বললাম, তালা খোলার কোড নাম্বার। তাই না?
হ্যাঁ T.L-2. R-3. L-l. R-4, ব্যাপারটা সোজা। কর্নেল শেষবার চাকতিটা ঘোরানোর পর ওপরের ডালাটা খুলে গেল। ভেতরে আবার একটা প্যাকেট দেখতে পেলাম। কর্নেল সেটা তুলে জ্যাকেটের ভেতরপকেটে চালান করে ডালা বন্ধ করে দিলেন। খুট করে শব্দ হলো। কর্নেল বললেন, T হলো Turn. অর্থাৎ ঘোরাও। L হলো Left এবং R হলো Right. তার মানে প্রথমে চাকতিটা বাঁদিকে ২নম্বর পর্যন্ত ঘোরাও। তারপর ডানদিকে ফের ঘোরাও ৩নম্বর পর্যন্ত। আবার বাঁদিকে ১ নম্বর পর্যন্ত ঘুরিয়ে ডানদিকে ৪ নম্বর পর্যন্ত ঘোরালেই তালা খুলে যাবে। মন্দিরে পৌঁছুবার আগেই হালদারমশাইকে ধরতে হবে।
নদীর ধারের ছোট গেটটা এবার ভেজানো দেখতে পেলাম। বোঝা গেল, হালদারমশাই চাবি নিয়ে এসেছেন ফার্ম হাউস থেকে। গেট দিয়ে বেরিয়ে কর্নেল হালদারমশাইকে খুঁজছিলেন। একটু পরে বললেন, ব্রিজের ওধারে দাঁড়িয়ে আছেন দেখছি। কোনও মতলব ভঁজছেন সম্ভবত।
আমরা নদীর ধারে ধারে ঝোপজঙ্গলের আড়ালে হন্তদন্ত এগিয়ে কাঠের ব্রিজে পৌঁছুলাম। ব্রিজের ওপারে একটা প্রকাণ্ড পাথরের কাছে হালদারমশাইয়ের ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছিল। কাছাকাছি গিয়ে কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, হালদারমশাই।
গোয়েন্দা ভদ্রলোক লাফিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়ালেন। আইয়া পড়ছেন? ভেরি গুড। বলে সেই পরগাছার ঝাড়টা তুলে ধরলেন। পরগাছা চায় কিডন্যাপার। হরনাথবাবুরে দিয়া চিঠি লিখছে–
কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, পরগাছার ভেতর এই জিনিসটা ঢুকিয়ে নিয়ে যান।
অ্যাঁ? ক্কী কইলেন?
কর্নেল সেই চৌকো কৗটোটা ওঁর হাতের পরগাছার ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর কিটব্যাগ থেকে নাইলনের দড়ি বের করে বেঁধে ফেললেন ওটা। হালদারমশাই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কর্নেল বললেন, সময় হয়ে গেছে। এবার শীগগির ভবানীমন্দিরে চলে যান। পরগাছাটা রেখেই চলে আসবেন কিন্তু।
বাট হোয়াট ইজ দ্যাট থিং কর্নেলস্যার?
টাইমোমা।
অ্যাঁ? খাইছে! খি-খি করে হেসে উঠলেন গোয়ন্দাপ্রবর।
কুইক! রেখেই চলে আসবেন।
পথে বার্স্ট করবে না তো?
নাহ্।
হালদারমশাই আবছা আঁধারে গাছপালার ভেতর দিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। কর্নেল বললেন, চিলোফেরা যাক।
হাঁটতে হাঁটতে বললাম, গুপ্তধনের নকশা দিলেন না। কিন্তু রাত দশটায় চিচিং ফাঁক অর্থাৎ ওই কোড নাম্বারটা ডিস্কোকে দেবেন। আমার মনে হয় না ডিস্কো এত বোকা যে কোড নাম্বারের সাহায্যে কৌটো খুলেই যখন দেখবে কিছু নেই, তখন ক্ষেপে গিয়ে হরনাথবাবুকে নির্ঘাৎ খুন করে ফেলবে।
কর্নেল বললেন, চুপচাপ এস। ও সব কথা পরে হবে।
অমরেন্দ্র সিংহরায়ের বাড়ির কাছে পৌঁছে কর্নেল বললেন, তুমি গিয়ে রায়সায়েবের সঙ্গে গল্প করো। বলবে, আমার চুরুট ফুরিয়ে গেছে বাজারে আনতে গেছি।
উনি হন হন করে এগিয়ে গেলেন। গেটে উঠে দেখলাম, বাড়ির চারদিকে আলো জ্বলছে। বারান্দায় চেয়ারে একা বসে আছেন রায়সায়েব। আমি সাড়া দেবার আগেই দেখতে পেয়ে হাঁকলেন, বেচু! তালা খুলে দে।
গেটটা সবসময় তালাবন্ধ থাকে দেখছি। বাড়ির চারদিকে আলোর ব্যবস্থা করার কারণ সম্ভবত ভৌতিক উৎপাত। কিন্তু কর্নেল যে বললেন দুটো ভূতকে পকেটস্থ করেছেন, তার মানে কী?
বেচু তালা খুলে বলল, কর্নেলসায়েব কোথায় গেলেন?
বললাম, চুরুট কিনতে।
বেচু বলল, আমাকে বললেই তো এনে দিতাম।
অমরেন্দ্র শুনতে পেয়ে বললেন, কর্নেলসায়েবের চুরুট তুই আনতিস? চিনিস উনি কী চুরুট খান? খালি সবতাতেই ফেঁপরদালালি। যা! জয়ন্তবাবুর জন্য খাবার নিয়ে আয়। খিদে পেয়েছে ওঁর।
বারান্দায় উঠে বললাম, নাহ্। খিদে পায়নি। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।