কৈ হালদারমশাই?
ফার্ম হাউসের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন আর এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে হাতমুখ নেড়ে গল্প করছেন। হরনাথবাবুর স্ত্রী ছাড়া আর কে হতে পারেন?
দেখি। বাইনোকুলারটা দিন।
কর্নেল বাইনোকুলার দিলেন না। বললেন, ডিস্কোর চেলাদের চোখে পড়ে যাব। চলল, নদীর ধারে নেমে যাই। ফার্মের একটা গেট আছে নদীর ধারে। ভেতরে ঢোকা যায় কি না চেষ্টা করা যাবে।
নিচে বড় বড় পাথর এবং ঝোপঝাড়ের আড়ালে আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম। মাঝেমাঝে কর্নেল বাইনোকুলারে চারদিক দেখে নিচ্ছিলেন। কিছুদূর চলার পর ফার্মের কাঁটাতারের বেড়া দেখা গেল। তারপর লোহার গরাদ দেওয়া ছোট একটা গেট চোখে পড়ল। গেটের দুপাশে ঘন ঝোপঝাড়। কর্নেল ইশারায় গুঁড়ি মেরে বসতে বললেন। নিজেও বসলেন। তারপর বাইনোকুলারে চোখ রেখে ফার্মের ভেতরটা দেখতে থাকলেন।
একটু পরে বললেন, হালদারমশাই মই যোগাড় করেছেন। হয়তো ফার্ম হাউসেই মইটা ছিল। কিন্তু উনি সঠিক গাছ এবং সঠিক অর্কিড চিনতে পারবেন কি?
পিঠের কিটব্যাগটি নামিয়ে কর্নেল চেন খুলে একগোছা চাবি বের করলেন। গেটের ওপাশে লটকানো লাটার মধ্যে কয়েকটা চাবি ঢোকানোর চেষ্টা করে বললেন, নাহ্। বেয়াড়া তালা। বরং কাঁটাতার কেটেই ঢোকা যাক।
কিটব্যাগ থেকে বেঁটে এবং চ্যাপ্টা একটা সাঁড়াশির মতো জিনিস বের করে পাশের কয়েকসারি তার কেটে ফেললেন। তারপর তারগুলো দুমড়ে সরিয়ে বললেন, কুইক! গুঁড়ি মেরে এস। বাঁদিকের ঝোঁপের আড়ালে এগোতে হবে।
একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, এই বিশ্রী অ্যাডভেঞ্চার না করে সোজা ফার্ম হাউসের বড় গেট দিয়ে ঢুকলে কী ক্ষতি হতো?
ডিস্কোর লোকেরা ওখানেই নজর রেখেছে। কারণ অর্কিডটা কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কি না, তারা নিশ্চয় দেখতে চাইবে। সেখানে আমার এই মার্কামারা চেহারা হরনাথবাবুর পক্ষে ক্ষতিকর। ভুলে যেও না, ডিস্কো আমাকে জানিয়ে রেখেছে। হরনাথবাবুকে কেন সে কিডন্যাপ করল। কর্নেল দাড়ি থেকে একটা পোকা বের করে একটু হাসলেন। দাড়ির এই সমস্যা! পোকামাকড় নিয়ে একটুআধটু চৰ্চা করি বলেই কি না জানি না, ওরা আমার দাড়িতে ঢুকে থাকতে ভালবাসে।
আলে দ্রুত কমে যাচ্ছে। প্রতিমুহূর্তে সাপের ভয়ে চমকে উঠছি। কিন্তু এ কোনও নতুন ঘটনা নয়। আমার বৃদ্ধ বন্ধু নাকি সাপের গন্ধ টের পান। ব্যাপারটা সত্য বা মিথ্যা যা-ই হোক, এ পর্যন্ত কখনো এধরনের অ্যাডভেঞ্চারে সাপের পাল্লায় পড়িনি।
এদিকটায় পাথর পড়ে আছে জায়গায় জায়গায়। পাথরের ফাঁকে ঝোপ গজিয়েছে। পাথরের জন্যই এ দিকটায় চাষবাস করা হয়নি। ক্রমশ একটা দুটো করে গাছ দেখা গেল। তারপর ঘন গাছের জঙ্গল। তবে তলাটা পরিষ্কার। কোনও ঝোপঝাড় নেই। অসমতল মাটি। বড় বড় পাথর। হালদারমশাই ফার্মের এই জঙ্গলটার কথাই বলেছিলেন।
গাছপালায় পাখিরা তুমুল হল্লা জুড়েছে। আবছা আঁধারে গুঁড়ি মেরে এগোতে এগোতে পায়ে আর পিঠে ব্যথা ধরে যাচ্ছিল। অবশেষে কর্নেল থামলেন। চাপা স্বরে বললেন, হালদারমশাই কাছাকাছি কোথাও আছেন। কারও সঙ্গে কথা বলছেন। ফার্মের লোকেদের মধ্যে ডিস্কোর চর আছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। না থাকলে ডিস্কো মুক্তিপণ হিসেবে পরগাছা দাবি করত না। সে জেনে ফেলেছে, কোথায় জিনিসটা লুকোনো আছে। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। গাছের গুঁড়ির আড়ালে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেলেন। ওঁকে অনুসরণ করলাম।
এতক্ষণে হালদারমশাইয়ের কথা কানে এল। ভাইটি! দ্যাখবেন য্যান পাও হড়কাইয়া না যায়। ওঠেন! টাইম নষ্ট করবেন না।
কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, হালদারমশাই করছেন কী! নিজে মইয়ে উঠছেন না। লোকটা যদি ডিস্কোর চর হয়, তা হলে কেলেংকারি!
হালদারমশাইয়ের কথা শোনা গেল। ডগায় ওঠেন। এক্কেরে পিকে। কাটারি দিয়া গোড়ায় কোপ মারবেন। নিচে ফ্যালাইবেন। হেভি পরগাছা।
সামনে কোথাও কোনও গাছের ডগায় কাটারির কোপ মারার শব্দ শোনা গেল। কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, জিনিসটা ছিটকে পড়ে যেতে পারে। খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। করছেন কী হালদারমশাই? এস তো, দেখি।
আমরা কয়েক পা এগিয়েছি, সামনে গাছের ডালপালার ভেতর সড়সড় শব্দ হলো। তারপর টর্চের আলো জ্বলে উঠল। হালদারমশাই বললেন, যাঃ! আটকাইয়া গেল যে ভাইটি। এক কাম করেন। সিঁড়ি থাক। ডালে পাও দিয়া-হঃ। আমি আলো দেখাইতাছি।
টর্চের আলোয় উঁচু ডালে আটকেপড়া প্রকাণ্ড একটা ফুলন্ত অর্কিডের ঝাড় দেখা যাচ্ছিল। হাফপ্যান্ট গেঞ্জি পরা একটা লোক কাটারি হাতে মই থেকে ডালে পা। রাখার চেষ্টা করছিল। অনেক কসরত করে সে পা রাখল। তারপর কাটারি দিয়ে ঠেলে অর্কিডটা ফেলে দিল। দেখলাম, টর্চ জ্বেলে লম্বা পায়ে হালদারমশাই সেদিকে এগিয়ে গেলেন। গাছ থেকে লোকটা প্রায় চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিল, আলো দেখান! আলো দেখান। নামব কী করে?
হালদারমশাই আলো ফেললেন গাছের ডগায়। তাঁর এক গ্রতে টর্চ, অন্য হাতে অর্কিডের প্রকাণ্ড ঝাড়টা উল্টো হয়ে ঝুলছিল। সেটা একটা বস্তায় ভরলেন। তারপর আলো দেখালেন। লোকটা অনেক চেষ্টার পর মই বেয়ে নেমে এল। হালদারমশাই বললেন, সিঁড়িখান লইয়া যান। মাঠানেরে কইবেন, চিন্তার কারণ নাই। আমি যাই গিয়া।
লোকটা মই নামিয়ে টানতে টানতে নিয়ে গেল। অদ্ভুত শব্দ হচ্ছিল মইটার। হালদারমশাই টর্চের আলো জ্বেলে জঙ্গলের ভেতর উধাও হয়ে গেলেন। কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, হালদারমশাই বুদ্ধিমান। ওঁর টর্চের আলোয় দেখলাম, গাছটার গায়ে একটা স্বস্তিকাচিহ্ন খোদাই করা আছে। কাজেই সঠিক গাছ এবং সঠিক অর্কিড।