অমরেন্দ্র একটু চমকে উঠলেন। আস্তে বললেন, জিনিস, মানে একটা ভিডিও ক্যাসেট। ওই যে সব বিলিতি অশ্লীল ক্যাসেট পাওয়া যায়–
ব্লু ফিল্মের ক্যাসেট?
তা-ই বলেছিল হরনাথ। ওর বাড়িতে ভি সি পি-টিভি এ সব আছে। বউ বুড়ি হলে কি হবে? হরনাথের আবার একটু-আধটু… হাসলেন অমরেন্দ্র। বলছিলাম না? সন্তানাদি নেই। ওর বউ ওইসব দেখে সময় কাটায়। তো হরনাথ বলেছিল, ভুল করে এই অশ্লীল ক্যাসেটটা কিনে ফেলেছে। পুলিশ নাকি এই সব ক্যাসেট দেখলেই অ্যারেস্ট করবে। আমার বাড়িতে টিভি আছে। সতুর ঘরেই থাকে। আমার ওসব দেখতে ভাল লাগে না। তবে নাহ্। ভি সি পি নেই। সতু বলছিল, শীগগির একটা কিনবে।
সত্যকাম?
হ্যাঁ। অমরেন্দ্র গম্ভীর হলেন। যাইহোক, হরনাথ প্যাকেটে ভরে চুপিচুপি আমাকে রাতে দিয়েছিল।
কতদিন আগে?
এই তো–গত মাসের শেষাশেষি।
এখন সেটা আছে?
না। আজ শুক্করবার। গত শুক্কুরবার সন্ধ্যায় হরনাথ এসে ফেরত নিয়ে গেল। বলল, খদ্দের পেয়েছে। বেচে দেবে।
বাইরে বেচুর সাড়া পাওয়া গেল। অমরেন্দ্র হাঁকলেন, বেচু।
বেচু পর্দা তুলে বলল, দিদিমণি বাজারে যেতে বলছেন। এদিকে সাইকেলের চাকায় লিক। আবার হেঁটে যেতে হবে। বলুন, আপনার কিছু আনতে হবে নাকি।
অমরেন্দ্র পকেট থেকে একটা প্রেসক্রিপশন বের করে দিয়ে বললেন, নবীন বলেছিল–ঢ্যারা দেওয়া আছে দেখবি, ওই ওষুধটা এবেলা আসবে। নিয়ে আসবি যেন।
বেচু চলে গেল। অমরেন্দ্র হাসলেন। ঘুমের ওষুধ যে! সেটা কোনও দোকানে পাওয়া যায় না।
কর্নেল বললেন, ঘুমের ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়।
ডাক্তার বলল, ঠিক ঘুমের ওষুধ নয়। ট্রাংকুলাইজার। আসলে রাতবিরেতে ওই সব ভুতুড়ে কাণ্ডের জন্য শরীরের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। এদিকে আপনিও আসছেন না।
ভৌতিক উৎপাত বন্ধ হয়েছে আশা করি।
অমরেন্দ্র জোরালো হাসলেন। আপনি আসছেন শুনেই হয়তো পালিয়েছে। কদিন থেকে আর কোনও সাড়াশব্দ পাচ্ছি না।
কালো বেড়ালটা?
বেড়ালটাকে মাঝে মাঝে দেখতে পাই। তবে আমার ধারণা, ওটা বেড়ালই বটে। বলে অমরেন্দ্র আবার গম্ভীর হলেন। সেই কাগজটার রহস্য উদ্ধার করতে পারলেন?
রহস্যের ঘাঁটি তো এখানে। দেখা যাক্। কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন, আপনি আপনার শ্যালকের ছেলে রথীনবাবুর স্ত্রীকে কি চিনতেন?
অমরেন্দ্র বাঁকা মুখে বললেন, খারাপ মেয়ে। হরনাথের দোষ ছিল না। হরনাথ এতটুকু থেকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছিল। কিন্তু খারাপকে ভাল করে সাধ্য কার? রথীনকে নিয়ে ভেগে গেল। আর বটুকও এমন লোক, পলিটিক্সই ওকে খেয়েছিল। রথীনকে কলকাতায় ব্যবসা করতে টাকা যোগাত। কিন্তু খবরও নিত না ছেলে সত্যি ব্যবসা করছে, না ফুর্তি মেরে টাকা ওড়াচ্ছে। শেষে হারামজাদি মেয়েটাই রথীনকে লোক দিয়ে মার্ডার করিয়েছিল। বটুক এমন পাপিষ্ঠ যে খবর শুনেও চুপ করে রইল। সাধে কি আমি ওঁকে ঘেন্না করতাম।
চন্দ্রিকাকে রাঙাটুলিতে শেষ কবে দেখেছেন?
অমরেন্দ্র অবাক হয়ে বললেন, চন্দ্রিকা–আপনি চন্দ্রিকাকে চিনতেন নাকি?
একটু-আধটু।
পরশু হরনাথ এসেছিল। বলছিল, চন্দ্রিকা নাকি মার্ডার হয়েছে। হতোই। জীবন নিয়ে জুয়োখেলা–মেয়ে হয়ে! পাপের শাস্তি। কী বলেন?
কনেল বললেন, চন্দ্রিকা হরনাথবাবুর কাছে সম্প্রতি এসেছিল কি না জানেন? এলে হরনাথবাবু আপনার কাছে নিশ্চয় গোপন কবেন না?
অমরেন্দ্র চাপা শ্বাস ছেড়ে বললেন, মাসখানেক আগে রাত্রে এসে রাত্রেই কলকাতা চলে গিয়েছিল। হরনাথ বলেছিল, বাবা-মায়ের জিনিসপত্র নিতে এসেছিল চন্দ্রিকা।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, এক চক্কর ঘুরে আসি।
অমরেন্দ্র ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কিছু খাওয়া-দাওয়া না করে বেরোবেন কী! সুনন্দা হয়তো আপনাদের জন্য খাবার তৈরি করছে। এক মিনিট!
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, পৌনে পাঁচটা বাজে। এখনই না বেরোলে ময়। আপনি সুনন্দাকে বলুন, ফিরে এসে একেবারে ডিনারে বসব। জয়ন্ত, উঠে পড়ো। ….
নিচের রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, তা হলে চিচিং ফাঁক রহস্য ফাঁস হলো।
অবাক হয়ে বললাম, কৈ ফাঁস হলো?
ব্লু ফিল্মের ক্যাসেট।
তার মানে?
তার মানে চিচিং ফাঁক রহস্য। কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন। একটা রিকশো পেলে ভাল হতো। হরনাথবাবুর ফার্ম প্রায় দেড় কিমি দূরে।
কিন্তু ব্লু ফিল্মের ক্যাসেট–
ব্রিটিশ আর্মির গুপ্তধনের নকশা ওটার মধ্যেই আছে। ওটা ক্যাসেট নয়। কোনও শক্ত ধাতু দিয়ে তৈরি একই গড়নের আধার।
কী সর্বনাশ। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।
সর্বনাশের মুখে দাঁড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়, ডার্লিং! চটপট হাঁটো!
বেলা পড়ে এসেছে। রোদের রঙ ঝিমধরা। এখনই গাছপালা আর উঁচু-নিচু টিলার মাথায় আবছা কুয়াশা ঘনিয়ে এসেছে। কিছুটা পথ দুধারে ঘন জঙ্গল। তারপর বাঁ দিকে সামান্য দূরে কয়েকটা একতলা ঘর এবং কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া ফসলের খেত দেখা গেল। বেড়াটা রাস্তার সমাালে এগিয়ে গেছে। আরও কিছুটা নার পর একটা ছোট্ট নদী দেখতে পেলাম। রাস্তাটা বাঁক নিয়ে কাঠের পোল পেরিয়ে গেছে। কাঠের পোলে দাঁড়িয়ে কর্নেল বাইনোকুলারে ফার্মটা দেখতে থাকলেন। কোথাও জনমানুষ নেই। ফার্মের জমিতেও কোনও লোক নেই। থাকলেও খালি চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম না।
বাইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল একটু হেসে বললেন, হালদারমশাই শেষ রক্ষা করতে পারেন কি না দেখা যাক।