কর্নেল চুরুট ধরাচ্ছিলেন। ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, আর ও সব কথা নয়। ওই দেখ, রায়সায়েব এসে পড়েছেন।
আস্তে বলালম, একটা কথার জবাব দিন। বেড়ালটার সঙ্গে তাহলে বেচুর ভাব থাকারই কথা। কিন্তু আমরা দেখলাম, সে লাঠি নিয়ে ওকে তাড়া করেছে।
ভাব থাকলেও সব সময় এসে টমাটো সসের জন্য ম্যাঁও করবে, এটা বেচু বরদাস্ত করবে কেন? তাছাড়া কালো বেড়ালকে অপয়া মনে করা হয়। কর্নেল উঠে বারান্দায় গেলেন। যেন নিজের বাড়িতে বাইরের লোককে অভ্যর্থনা করছেন, এমন ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে বললেন, হ্যালো রায়সায়েব! সুনন্দা কেমন আছ? আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। হাজারটা ঝামেলা নিয়ে থাকি।
অমরেন্দ্র কর্নেলের করমর্দন করলেন। সুনন্দা কর্নেলের পায়ে প্রণাম করলেন। প্রৌঢ়া মহিলা। এখনও আঁচ করা যায়, যৌবনে লাবণ্যময়ী ছিলেন। কিন্তু মুখে কী যেন যন্ত্রণার স্থায়ী ছাপ পড়ে আছে।
অমরেন্দ্র বললেন, ওদিকে এক সর্বনাশ! হরনাথকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না কাল সকাল থেকে। ওর বউ কাল সন্ধ্যায় হরনাথের লেখা চিঠি পেয়েছে। চিঠিটা–কী বলব? বোকা মেয়ে। ভোরে কি এক প্রাইভেট ডিটেকটিভ এসেছে কলকাতা থেকে। তাকে দিয়েছে বলল। বুঝুন অবস্থা।
কী লেখা ছিল চিঠিতে?
সুনন্দা কর্নেলের পাশ কাটিয়ে আমার দিকে একবার তাকিয়েই হলঘরে ঢুকে গেলেন। লক্ষ্য করলাম, উনি সোফার দিকের একটা ঘরের দরজার তালা খুলছেন।
অমরেন্দ্র চাপা স্বরে বললেন, হরনাথের বউ বরাবর বোকা। বোকা আর ছিচকাঁদুনি। আসলে সন্তানাদি নেই। বাড়িতে একা থাকে। এদিকে হরনাথ পড়ে থাকে নদীর ধারে ফার্মে। তো চিঠির সব কথা গুছিয়ে বলবে কী, কেঁদেই অস্থির। যেটুকু বুঝলাম, তাতে মনে হলো, হরনাথ লিখেছে, তার জন্য চিন্তার কারণ নেই। আজ রাত্রেই বাড়ি ফিরবে। তবে ওর ফার্মের একটা গাছের ডগায় নাকি মস্ত বড় একটা পরগাছা আছে, সেটা ডাল থেকে উপড়ে থলেয় ভরে সন্ধ্যার পর ভবানীমন্দিরে রেখে আসতে হবে। আমি তো এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝলাম না।
কথা বলতে বলতে অমরেন্দ্র হলঘরে ঢুকলেন। সুনন্দা সেই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, কর্নেলসায়েবের ঘর খুলে দিয়েছি।
বলে উনি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলেন। অমরেন্দ্র বললেন, চলুন। ঘরে বসে আলোচনা করা যাক। আসুন জয়ন্তবাবু।
.
ঘরটা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। জানালার পর্দা সরানো। বাইরে ঘাস আর ঝোপঝাড়ে ঢাকা প্রাঙ্গণ। তার ওধারে জরাজীর্ণ পাঁচিল। পাঁচিলের ওপারে বিশাল উঁচু গাছ। ঘরটা বেশ সাজানোগোছানো দেখে ভাল লাগল। পেছনের দিকে দরজা এবং একটুকরো খোলা বারান্দা আছে।
কর্নেল বললেন, হরনাথবাবু লেখেননি কেউ ওঁকে আটকে রেখেছে?
অমরেন্দ্র বললেন, লিখেছে। সেটাই তো আমার অবাক লাগছে। কে ওকে আটকে রাখবে? একটা পরগাছা কেনই বা ভবানীমন্দিরে পৌঁছে দিতে হবে? পুলিশে খবর দিলে নাকি ওর বাড়ি ফেরা হবে না। এই সব কথা লিখেছে। আমার কিন্তু খুব রাগ হলো শুনে। আমার সঙ্গে কনসাল্ট করা উচিত ছিল। কাল বিকেলে খবর নিতে গিয়েছিলাম। হরনাথ, তখনও ফেরেনি শুনে বলে এসেছিলাম, সন্ধ্যার পরও খোঁজ না পেলে খবর দিও? দেয়নি। আজ সকালেও দেয়নি। দুপুরে হরনাথের ফার্মের মদনবাবুর সঙ্গে দেখা হলো রাস্তায়। জিজ্ঞেস করলে বলল, বাবু এখনও বাড়ি ফেরেনি। তাই সুনন্দাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোলাম। গিয়েই এইসব কথা শুনে অবাক।
কর্নেল বললেন, বেচুকে কোথায় পাঠালেন?
কোথাও পাঠাইনি। আমরা রিকশোয় এলাম। ও হেঁটে আসছে। অমরেন্দ্র একটু হাসলেন। কফি চাই তো? সুনন্দা আছে, ভাববেন না।
কফি বেচু খাইয়েছে। এখন আর দরকার হবে না।
অমরেন্দ্র আবার চাপাস্বরে বললেন, পরগাছার ব্যাপারটা সন্দেহজনক। আপনার মনে আছে অনাথবন্ধুর কথা? সেই যে পাগলা প্রফেসর–
হ্যাঁ। অনাথবন্ধু রায়। ওর মেয়ে মৃদুলার সঙ্গে ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির বিয়ে হয়েছে না?
চেনেন নাকি ওদের? চিনি।
নাটকের দল আছে ইন্দ্রজিৎবাবুর।
অমরেন্দ্র বাঁকা মুখে বললেন, ধানবাদের ছেলে। বটুকের একনম্বর চেলা ছিল। তা হলেই বুঝুন কী জিনিস। আজকাল পলিটিক্স ছেড়ে নাটক করছে বুঝি? খুব ভাল। তো যা বলছিলাম, অনাথবন্ধুর কিন্তু পরগাছার ওপর খুব লোভ আছে দেখেছি। পাগলার কাণ্ড। হরনাথের ফার্মে কোনও ভাল পরগাছা দেখে তারই লোভে ওকে আটকে রাখেনি তো?
কর্নেল হাসলেন। পরগাছার নেশা তো আমারও আছে। তাই বলে—
অমরেন্দ্র বাধা নিয়ে বললেন, আহা! আপনি তো অনাথবন্ধুর মতো উন্মাদ নন।
ভদ্রলোক এখন কোথায় আছেন?
জানি না। রাঙাটুলির বাড়িটাতে মৃদুলার মেলোমশাই আর মাসি থাকেন। নবাদেও নাকি একটা বাড়ি আছে। অমরেন্দ্র সন্দিগ্ধভাবে বললেন, আমার মনে হচ্ছে, এ অনাথবন্ধুরই কীর্তি। বুঝলেন না? সায়েন্টিস্ট লোক। হয়তো সায়েন্সের কোনও গবেষণার জন্য পরগাছাটা দরকার। এমনও হতে পারে, হরনাথের কাছে চেয়েছিল। হরনাথ দেয়নি। তাই ওকে কৌশলে কোথাও আটকে রেখেছে।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন, একটা কথা। হরনাথবাবু তো আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু?
ঘনিষ্ঠ মানে? একেবারে হাফ পেন্টুল পরা বয়স থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। কেউ কারও কোনও কথা গোপন রাখি না। আপনি স্বচক্ষে দেখেও গেছেন দুজনের মধ্যে কী সম্পর্ক।
সম্প্রতি হরনাথ কি কোনও জিনিস আপনাকে রাখতে দিয়েছিলেন?